ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

থেমে গেল আফ্রিকার কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২০ এপ্রিল ২০১৮

থেমে গেল আফ্রিকার কণ্ঠস্বর

মৃত্যু আড়াল করতে পারে না কৃর্তীমানের কর্ম। নেতা হারালেও হারায় না তার নেতৃত্বের আভায় অর্জিত সাফল্য। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতির অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তি, আন্দোলন সংগ্রামের প্রাণ। এক নির্ভীক নেতা। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে। ছিলেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত এক নেত্রী। স্বজাতির স্বাধীনতা ছিল তার স্বপ্ন ও পন। আজীবন সম্পৃক্ত থেকেছেন রাজনীতি আর দুর্বলের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস মহিলা লীগের প্রধান ও এএনসির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের পক্ষে ২০০৯ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সাংসদ ও ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপমন্ত্রী। ৩৫ বছর তাকে টিকে থাকতে হয়েছে শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্বকামী শাসকদের সঙ্গে লড়াই, সংগ্রাম করে। যার প্রতিবাদী কণ্ঠ সর্বদা উচ্চকিত হয়েছে শোষিত, নির্যাতিত, কালো দক্ষিণ আফ্রিকানদের পক্ষে। অসহায় স্বজাতিকে স্বাধীন করার জন্য হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে রক্তাত্ব ক্ষত-বিক্ষত পায়ে যিনি পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ বন্ধুর পথ। তবুও চুল পরিমাণ সরে দাঁড়াননি নিজ আদর্শ থেকে। শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। সেই অকুতোভয়, সাহসী, সংগ্রামী, লড়াকু, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর, দেশটির বহু মানুষের কছে জাতির মাতাÑ উইনি মাদিকিজেলা ম্যান্ডেলা, গত ২ এপ্রিল পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই ফার্স্ট লেডির জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ট্রান্সকেই (বর্তমান ইস্টার্ন কেপ)। স্কুলশিক্ষক পিতা, আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা নাম রেখেছিলেন নমজামো উইনিফ্রেড মাদিকিজেলা। আফ্রিকার জনজাতীয় ভাষায় নমজামো মানে যাকে সারাটা জীবন পরীক্ষা দিতে হয়। তা অবশ্য তিনি দিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, তাকে দিতে হয়েছে। বহন করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার করুণ ও কঠিন ইতিহাস। আজীবনই পরীক্ষা দিয়েছেন জয়-পরাজয়ে, সত্য-মিথ্যায়, উত্থান-পতনে। তবুও পথ চলেছেন মাথা উঁচু করে। উইনির ছেলেবেলা কাটে ইস্টার্ন কেপের পন্ডোল্যান্ড অঞ্চলে। ম্যট্রিক পরীক্ষা দিয়ে জোহানেসবার্গে চলে আসেন উদ্দেশ্য সমাজসেবা নিয়ে পড়াশোনা। লেখাপড়ায় ছিলেন ভাল। স্কলারশিপ পেয়েছিলেন আমেরিকায় পড়ার। যাননি। সেই সময়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী উইনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযুক্ত করে গড়েছিলেন নিজেকে। তখন থেকেই আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস, বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ শুরু। পড়ালেখা শেষ করে জোহানেসবার্গের বারাগওয়ানাথ হাসপাতালে সমাজকর্মীর কাজ শুরু করেন তিনি। বৃদ্ধি পেতে থাকে সমাজ সচেতনতা। গবেষণা করেন আলেকজান্দ্রায় শিশু মৃত্যু নিয়ে। উইনি বলেন, ‘আমি দারিদ্র্য বিষয়টি বুঝতে শুরু করি। বেশিরভাগ মানুষকে জোর করে দরিদ্র পরিস্থিতিতে রাখা হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা বৈষম্যের মাধ্যমে ভয়াবহ ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।’ ২২ বছর বয়সে সোয়েতোর এক বাস স্ট্যান্ডে নেলসন ম্যন্ডেলার সঙ্গে প্রথম দেখা তার। ১৯৫৮তে বিয়ে। ওই বছরের অক্টোবর মাসে শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত কিছু এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধে নারীদের আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন ইউনি। বিবাহিত জীবন ৩৮ বছরের। যার ২৭ বছরই নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন কারাগারে। ১৯৬৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার যেদিন যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ হয়, শান্ত গলায় উইনি বলেছিলেন, ‘তবু ভাল! মৃত্যুদ- দেয়নি।’ সেদিন উইনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন ‘আমার এবং আমাদের কারোরই কখনই আশা ছাড়া উচিত হবে না। আসলে আমি মনে করি এ অন্দোলন চলতে থাকবে।’ দৃঢ় প্রত্যয়ে শক্ত হাতে কঠিন সময় মোকাবেলার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউনি। আশ্বস্ত করেছেন তার দলের সদস্যদের। আন্দোলনের হাল তুলে নেন নিজের হাতে। অন্যদিকে সহধর্মিণী হিসেবে সান্ত¦না যুগিয়েছিলেন স্বামীকে। মুক্তির আশায় বেঁধে ছিলেন বুক। ম্যান্ডেলার বন্দীদশায় তিনিই হয়ে উঠেছিলেন দলের মুখপাত্র। তখন তিনি একাই সংসার সামলেছেন। দুই সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করেছেন। সরকারের অত্যাচার, আর দমন-নিপীড়নের মধ্যেও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকে রেখেছেন চাঙ্গা। নেলসন ম্যান্ডেলার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন অদম্য এই নারী। ম্যান্ডেলা জেলে থাকাকালীন ইউনি তার সঙ্গে কদাচিৎ সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন। ভেঙ্গে পড়েননি কখনই। বরং নিজের আবেগকে করেছেন কারারুদ্ধ। কারাবরণ করেছেন একাধিকবার। নির্জন কারাবাসে কাটিয়েছেন ৪৯১ দিন। ১৯৬৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ঘুপচি সলিটারি সেলে। সেখানে নিত্যসঙ্গী ছিল নির্যাতন, প্রহার, হয়রানি, নজরদারি। প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হয়েছেন অভিনব সব শাস্তির। নিত্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি সামগ্রী না পেয়ে ভেসেছেন নিজের রক্তে। ১৯৭৬-এ আবারও গ্রেফতার। এবার তাকে দেওয়া হলো নির্বাসন। নির্বাসনে অতিবাহিত করেছেন জীবনের আটটি বছর। তবুও কখনও পরাজয় মেনে নেননি। পিছ পা হননি নিজ আদর্শ ও নীতি থেকে। তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, কঠোর, চিত্তাকর্ষক। দলের স্বার্থে সর্বদা থেকেছেন অবিচল। আপোস করেননি কোন কিছুর সঙ্গেই। তাই নেলসন ম্যান্ডেলা যখন যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনকালের প্রেসিডেন্ট এফডব্লিউডি ক্লার্কের সঙ্গে ইউনি তখন তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন ম্যান্ডেলার সেই সিদ্ধান্তের। ২০১৩তে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনী ৪৯১ উধুং: চৎরংড়হবৎ ঘঁসনবৎ ১৩২৩/৬৯ । দক্ষিণ আফ্রিকার তামিল সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সারা জীবন তামিল সম্প্রদায়ের জন্য অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি । সে কারণেই সেখানকার তামিল ফেডারেশন ২০১৬ সালে তাকে আলিআম্মা সম্মানে সম্মানিত করে। তাকে নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। সময়ের কালচক্রে ইউনি হয়েছেন নিন্দিত। শঙ্কা থেকে যায়, প্রকাশিত তথ্যের আড়ালে চাপা পড়েনি তো ‘কোন কঠিন সত্য।’ উইনির মৃত্যু নতুন করে তাড়িত করুক সত্যানুসন্ধানে। ইতিহাস উন্মোচিত করুক সঠিক তথ্য। আশা করি সময় একদিন সে সত্য প্রকাশিত হবে। উইনিকে অতিবাহিত করতে হয়েছে রূঢ়, বিভীষিকাময় কষ্টের জীবন। দিনের পর দিন পুলিশের অসহনীয় নির্যাতন, মারধর সহ্য করেছেন তিনি। পরে তিনি লিখেছেন, পুলিশের কঠিন নির্যাতনই তার নিজের নিষ্ঠুরতাকে উস্কে দিয়েছিল, বুনে দিয়েছিল ঘৃণা। সেই ঘৃণাই ইউনিকে পরে বক্তৃতায় বলিয়ে নিয়েছিল, ‘দেশলাই আর নেকলেস দিয়ে আমরা স্বাধীনতা আনব!’ নেকলেস মানে গলায় জ্বলন্ত টায়ার পরিয়ে দেয়া। যা তার জীবনে লেপন করেছিল কলঙ্কের কালিমা। নিন্দিত হয়েছিলেন তিনি। কথাগুলো কি তাকে তীব্র যন্ত্রণার চাপে বলতে বাধ্য করা হয়েছিল নাকি তিনি নিজেই বলেছিলেন, তা এখন ভাববার বিষয়। ম্যান্ডেলা ইউনাইডেট ফুটবল ক্লাব নামে একটি সংগঠন করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে যাদের মনে করা হতো ইউনির দেহরক্ষী, আসলে তারা ছিলেন দলের মধ্যে চর খোঁজার বাহিনী। তাদের হাতেই চার যুবক এর অপহরণ ও হত্যা মামলায় (১৯৮৮) উইনি দোষী সাব্যস্ত হন। পাঁচ বছরের কারাদ- দেয়া হয় তাকে। পরে আপীলে তা জরিমানায় পৌঁছায়। ইতোমধ্যেই অন্ধকারের অতলে বিলীনের চেষ্টা শুরু হয়েছে কালজয়ী মহীয়সী এ নারীর ভাবমূর্তি। নেলসেল ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় ১৯৯৬ সালে। তাই বলে থেমে যায়নি চলার গতি। দলের অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত তিনি ছিলেন সোচ্চার। সময়কে প্রভাবিত করেছেন নিজের মতো করেই। এটা সত্যি, হিংসার মোকাবেলা তাকে করতে হয়েছে সহিংস পথে। কিন্তু সেটি কী তার একার দায় না পরিস্থিতির দাবি? সে প্রশ্ন সামনে আনতে হবে। গায়ের রং কালো বলে, নারী বলে ইতিহাসের পাতা থেকে তার নাম মুছে ফেলা যাবে না। নিজেকে তিনি স্থাপন করেছেন এমন এক উচ্চতায় যে, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, ন্যায়ের সংগ্রামে, ইউনি উচ্চারিত হবেন সাহসের আরেক নাম বলে। তার নেতৃত্ব, স্বজাতির প্রতি ভালবাসা আর সাহসিকতার জন্য তিনি শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয় সারা বিশ্বের সব নারী- পুরুষের কাছে উদাহরণ হয়ে রইবেন চিরকাল। ইউনি আপনার জন্য ভালবাসা।
×