ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজীব এখন কেবলই স্মৃতি...

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২০ এপ্রিল ২০১৮

রাজীব এখন কেবলই স্মৃতি...

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাউফল, ১৯ এপ্রিল ॥ রাজীব হোসেন এখন সবার কাছেই স্মৃতি হয়ে আছেন। এ জগতে রাজীবের অতি আপন বলতে কেবল অনাথ দুই ছোট ভাই বেঁচে আছে। তাদের নিয়েই যত স্বপ্ন দেখতেন রাজীব। দুই ভাই পড়ালেখা করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই সড়ক দানবের রেষারেষিতে হাত হারান তিনি। এর পর ১৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান। রাজীবের এ হৃদয়বিদারক ঘটনায় গোটা দেশ আলোড়িত। বুধবার সকাল সাড়ে দশটার সময় নানাবাড়ি বাউফলের দাশপাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে নানা ও নানির কবরের পাশে তাকে কবর দেয়া হয়েছে। অদূরেই রাজীবের মায়ের কবর। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে রাজীবের নানা মৃত মোকলেছুর রহমান লাল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, রাজীবের মেজখালা খাদিজা বেগম লিপি ও ছোট খালা হ্যাপি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত কাঁদছেন। কয়েক দিন ধরে বাবা-মা হারা রাজীবের জন্য কেঁদে কেঁদে তারাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মেজখালা খাদিজা বেগম জানান, রাজীব মাত্র আট বছর বয়সে মা ও ১১ বছর বয়সে বাবাকে হারান। তখন ছোট দুই ভাই মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহর বয়স ছিল যথাক্রমে আড়াই বছর ও এক বছর। অসময়ে মাতৃহারা এই তিন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার বাবা লাল মিয়া আমার ছোট বোনকে (রাজীবের ছোট খালা) রাজীবের বাবা হেলাল উদ্দিনের কাছে বিয়ে দেন। মৃত বোনের তিন ছেলেকে নিজের সন্তান মনে করেই সংসারের হাল ধরেন তিনি। কিন্তু তার ভাগ্যেও বেশিদিন সুখ সয়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর বোনের তিন ছেলেকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন। কিন্তু একটি সম্ভাবনাময় সময়ে এসেও সেই যুদ্ধে পড়াস্ত হয়েছেন তিনি। চোখের সামনে মারা যান তার আদরের রাজীব। খাদিজা বেগম আরও জানান, তিনি নিজেও নিঃসন্তান। তাই রাজীব, মেহেদী ও আবদুল্লাহকে সন্তানের মতো ভালবাসতেন। ছোট সময় তাদের নিজ হাতে খাইয়েছেন। পায়খানা-প্রস্্রাব পরিষ্কার করেছেন। আজ তাদের তিন সন্তানের একজন রাজীব নেই তিনি বিশ^াস করতেই পারছেন না। রাজীবের দুর্ঘটনার পর খবর পেয়ে তারা তিন বোন রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে যান। এক রাত রাজীবকে রাখা হয় ওই হাসপাতালে। পরের দিন বেলা এগারোটায় রাজীবকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ওই সময় তাদের কাছে শমরিতা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১ লাখ ২৬ হাজার টাকার একটি বিল ধরিয়ে দেন। তখন এত টাকা পরিশোধ করার মতো অবস্থা ছিল না তাদের। মাত্র ৫০ হাজার টাকা ছিল তাদের কাছে। ওই টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা তার বড় বোন জাহানারা বেগম পরে পরিশোধ করবেন এমন লিখিত অঙ্গিকার করে রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। এ্যাম্বুলেন্সে রাজীব তখন চোখ মেলে তাকাচ্ছিলেন। ছোট গলায় মেজখালাকে বলছিলেন, খালা আমার ডান হাত সোজা করে দাও। তখনও রাজীব জানত না তার ডান হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে গেছে। ওই সময় খালা তার বাম হাতটি ধরে সোজা করতে চাইলে রাজীব বলেন, খালা আমার বাম হাত তো সোজা রয়েছে, তুমি এটি আবার সোজা করতে চাও কেন ? তুমি আমার ডান হাত সোজা করে দাও। এর পর রাজীব বলেন, আমাকে একটু পানি দাও, আমি পানি খাব। গাড়ি আস্তে চালাতে বলো, আমার মাথাব্যথা করছে ইত্যাদি। এর পর হাসপাতালে নিয়ে একটি সাধারণ বেডে তোলা হয় তাকে। ১০ এপ্রিল রাতে রাজীব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নেয়া হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিউতে) । ১৭ এপ্রিল রাত ১২টা ৪০ মিনিটে রাজীব আমাদের ছেড়ে চলে যান। মধ্যে ১৪ দিন হাসপাতালে রাজীবের অসংখ্য স্মৃতি তাদের এখন তাড়িয়ে বেড়ায়। একটা রাতও তারা কেউ ঘুমাতে পারেননি। রাজীবের ছ্টো মা ছোট খালা) বলেন, রাজীব নেই বিশ^াস করতে পারছি না। ও খুব অভিমানী ছিল। কারও ওপর নির্ভর করতে চাইত না। ছোট সময় থেকে মামা ও খালাদের মাঝে থেকে বড় হলেও বড় হয়ে নিজেই কিছু করতে চাইত। আমাদের বলত, অনেক করেছ। এখন আমি করব। গত দুই বছর যাত্রাবাড়ী একটি ম্যাচে থেকে পড়ালেখা করত। ছোট দুই ভাই মেহেদী ও আবদুল্লাহ হাফেজী শেষ করে যাত্রবাড়ী আলিয়া আমিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। আর আমি থাকতাম বড় বোনের বাসায়। সময় পেলেই ওরা তিন ভাই চলে আসত ওই বাসায়। তখন অনেক কথা হতো। ভালমন্দ খেত। তিনি আরও বলেন, রাজীবের এই দুর্ঘটনার দুই বছর আগে তার বড় মামা জাহিদুল ইসলামের বিয়ের অনুষ্ঠানে গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন। এরপর এবার এলেন রাজীবের লাশ নিয়ে। রাজীবের দুর্ঘটানার পর থেকে লাশ কবর দেয়া পর্যন্ত অনেকেই আমাদের খোঁজ খবর নিয়েছেন। বিশেষ করে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিম ও চীফ হুইপ আসম ফিরোজ একাধিকবার রাজীবকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন। বর্তমানে ফেসবুকসহ কয়েকটি মিডিয়ায় আমাদের জড়িয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। আমরা নাকি রাজীবের ছোট দুই ভাইকে দত্তক দিতে চাই। আসলে এ খবর সত্য নয়। ওরা দুই ভাই আমাদের কাছেই থাকবে। তবে সরকারসহ কেউ যদি ওদের পড়ালেখার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চান, আমরা না বলব না। কারণ, এই এতিম দুই ভাইয়ের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি দেশবাসীর কাছে রাজীবের জন্য দোয়া কামনা করেছেন। পরিবারের কাছে অনুদানের টাকা হস্তান্তর ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, পটুয়াখালী থেকে জানান, বাস দুর্ঘটনায় নিহত তিতুমীর কলেজ ছাত্র রাজীব হোসেনের দুই সহোদর হাফেজ মেহেদী হাসান ও হাফেজ আবদুল্লাহর কাছে অনুদানের ৪৫ হাজার টাকা তুলে দিলেন জেলা প্রশাসক ড. মোঃ মাছুমুর রহমান। বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটায় জেলা প্রশাসকের দরবার হলে এ অনুদানের টাকা হস্তান্তর করেন। জেলা প্রশাসক এ ছাড়াও সমাজসেবার মাধ্যমে আরও এক লাখ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অপরদিকে উপবৃত্তির মাধ্যমে রাজীবের দুই ভাইকে মাসে ৬ শ’ টাকা করে দেয়ার কথা জানান। এ সময় নিহত রাজীবের খালা-মামা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ হেমায়েত উদ্দিনসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বপন ব্যানার্জী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
×