জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দীর্ঘ ৪৭ বছর ভিক্ষা করে নিজের আহার যুগিয়েছেন শহীদ জননী মেহেরজান বিবি। মুক্তিযুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে তার ৬ সন্তানও দেশের জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধাহত এই জননী ভিক্ষা করেই এতদিন বেঁচে আছেন। সব হারিয়ে তার ঠাঁই হয়েছে ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর আবাসন ও আশ্রায়ন প্রকল্পের ৩ নম্বর ব্যারাকের ১১ নম্বর কক্ষে। সেখানে থেকেই ৮৮ বছরের এই বৃদ্ধ জননী ভিক্ষা করে পেটের ক্ষুধা মেটাতেন। এরইমধ্যে কয়েকজন তরুণ মানবতার খাতিরে মেহেরজান বিবির পাশে দাঁড়ান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসে এই বীরমাতার দুর্দশার চিত্র। গত দুই সপ্তাহ আগে ভিক্ষা করার সময় পড়ে গিয়ে ডান পায়ে আঘাত পান এই জননী। এরপর তাকে ফেনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ফেনীর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তাকে রাজধানীর জাতীয় পঙ্গু হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে এই শহীদ জননী জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৫৫নং বিছানায় ভাঙা পা নিয়ে কাতরাচ্ছেন। জরুরী ভিত্তিতে মেহেরজান বিবির ডান পায়ে সার্জারি করতে হবে। মায়ের উন্নত চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন মেহেরজান বিবির ছেলে মোঃ শাহজাহান।
জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ মোঃ জাহাঙ্গীর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘তার অনেক বয়স হয়েছে। এই বয়সেও তিনি ভিক্ষার জন্য পথে পথে বেড়াতেন। পড়ে গিয়ে তার ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। এই অবস্থায় তার সার্জারি নিয়ে আমরা চিন্তিত। এই বয়সের রোগীকে অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার করাটা অনেক ঝুঁকির। আমরা তার শারীরিক অবস্থা দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। ইতোমধ্যেই আমরা তার সকল পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছি। আশা করছি শনিবার তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হবে।’
মেহেরজান বিবি ১৯৩০ সালের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইব্রাহীম উকিল। জানা গেছে, শহীদ এ্যাডভোকেট ইব্রাহীম ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উকিল। মেহেরজান বিবির মা বিবি হনুফা। পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুরহাটের ২৬ নম্বর দক্ষিণ তরপুর চ-ী গ্রামে। তারা তিন ভাই এবং তিন বোন। সোনাগাজী উপজেলার ৬ নম্বর চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজী বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের পুত্র সুবেদার এ টি এম সামসুদ্দিনের সঙ্গে মেহেরজান বিবির বিয়ে হয়। পঞ্চাশের দশকে বড়ধলী গ্রাম নদী গর্ভে বিলিন হলে নিঃস্ব হয়ে তারা ঢাকা শহরে চলে আসেন। ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরে জালাল দারোগার বাড়িতে থাকতেন বলে জানা যায়।
ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হতেন বলে জনকণ্ঠকে জানান মেহেরজান বিবি। নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। খুব সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ মনি এসে ডেকে নিয়ে গেল আমার ছয় সন্তানকে। রাতে হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দিল ঘরবাড়ি। সেই যে সন্তানরা গেল আর তো ফিরে এলো না। বঙ্গবন্ধু যতদিন ছিলেন খবর নিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর কেউ আর তেমন খবর রাখেনি।’ মেহেরজান বিবি জানালেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তার স্বামী ও ৬ সন্তানকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুল (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) এর শিক্ষিকা ছিলেন বলে জানান তিনি।
মেহেরজান বিবি জানান, স্বাধীনতার পর তার দুঃখ-কষ্টের কথা শেখ ফজলুল হক মনির দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ছাপা হলে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ও তার এক পুত্রবধূ করফুলের নেছাকে ডেকে নিয়ে দুই হাজার টাকা করে অনুদান দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বামী সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তার পুরোপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। স্বজন-পরিজন সব হারিয়ে চরম অসহায়ত্বের কারণে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেন তিনি। ২০০৯ সালে ফেনী রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতে দেখে জনৈক জিআরপি পুলিশ তাকে ফেনী জেলা প্রশাসনে পাঠান। তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় ধর্মপুর আবাসন প্রকল্পে। সেই থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করতেন।
মেহেরজান বিবির ৮ পুত্র ও ২ মেয়ে ছিল। তার ছয় পুত্র এবং স্বামী এ টি এম সামসুদ্দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন। তার শহীদ সন্তানেরা হলেনÑ ছায়েদুল হক (সে সময়ে সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম। দুই মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবি মারা গেছেন।’ সম্প্রতি মেহেরজান বিবিকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তার এক ছেলেকে ৩২ বছর পর পাওয়া গেছে। তার নাম মোঃ শাহ জাহান। তবে তার আরও এক ছেলে এখনও নিখোঁজ। তার নাম মোঃ শাহ আলম। মেহেরজান বিবির ছেলে মোঃ শাহজাহান দেশের সকলের কাছে তার অসুস্থ মায়ের জন্য দোয়া চেয়েছেন।
যে কয়েকজন তরুণের প্রয়াসে মেহেরজান বিবির করুণ দশা দেশের সামনে এসেছে তাদেরই একজন শেখ সাদী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গণাদের নিয়ে কাজ করছি। ব্যক্তিগতভাবে তাদের খোঁজখবর নেই ও যতটুকু পারি সাহায্য করি। হঠাৎ করেই তিন সপ্তাহ আগে আমার এক বন্ধু সংবাদ দেয় যে ফেনীতে এক শহীদ জননী দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে ভিক্ষা করেন। সে এই জননীর ছবি তুলে আমাকে পাঠায়। আমি ফেসবুকে তা শেয়ার করার পর তা ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার করুণ চিত্র উঠে আসে।’
সাদী আরও বলেন, ‘যারা আমাদের দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন সেসব মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের অনেক পরিবারই এই মায়ের মতো অবহেলিত জীবনযাপন করছে। আমরা তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমাদের কোন সংগঠন নেই। আমরা আট তরুণ মিলে ব্যক্তিগতভাবে নিজ দায়িত্ব মনে করে এসব মানুষের পাশে দাঁড়াই। প্রথমে আমরা যখন এই শহীদ জননীকে দেখতে গিয়েছিলাম তখন তিনি মাটিতে ঘুমাতেন। আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র অর্থায়নে তাকে একটি খাট, বিছানাসহ তার যাবতীয় জিনিসপত্র ও পোশাকের ব্যবস্থা করি। তার কাছ থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা একটি সার্টিফিকেট পেয়েছি। মেহেরজান বিবি জানান, এই সার্টিফিকেটের মাধ্যমে যুদ্ধের পর পরই সাহায্য পেয়েছিলেন। তারপর থেকে একে একে সরকার পরিবর্তন হলেও তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। যুদ্ধাহত মেহেরজান বিবি সরকারিভাবে কোন সাহায্য পাননি বলে জানান।
আক্ষেপ করে এই তরুণ বলেন, ‘দেশে এত এত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এবং কমান্ড আছে যে ৬ ছেলে ও স্বামীসহ ৭ জন হারানো পরিবারের সদস্য মেহেরজান আম্মার খোঁজ কোন সংগঠন নেয়নি। উনি এখন অসুস্থ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি সেখানেও তাকে দেখতে কেউ যায়নি। পদবী আছে অনেক- বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীরশ্রেষ্ঠ কিন্তু মেহেরজান আম্মার পদবি ভিখারি।’ জরুরী ভিত্তিতে মেহেরজান বিবির ডান পায়ে সার্জারি করতে হবে। টাকার অভাবে জরুরী চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে যারা সহযোগিতা করতে চান, উনার ছেলে মোঃ শাহজাহান পাটোয়ারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন- মোবাইল নং: ০১৭৪৫৪৭১৭৬৩