ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকনাম

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

ডাকনাম

‘সালটা ২০০৮ এর মাঝামাঝির দিকে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা সবেমাত্র শেষ করেছি। গিটারের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। এক পরিচিত বড় ভাইয়ের কাছে গিটারের ক্লাস করতাম। কয়েকটা পরিচিত গান গিটারে তুলতে পারতাম। তো- প্রায় প্রায়ই সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে রূপনগরের ঝিলপাড়ে বসে গানবাজনার আড্ডা চলত। একদিনের কথা। আমি গিটার নিয়ে গিয়ে দেখি ২-৩ জন বন্ধু চলে এসেছে। কিছুক্ষণ বসার পরই সবাই আমাকে বলল, ‘তুই থাক আমরা গেলাম।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ বলল, ‘আজাদ আসবে এখন আর এসেই কমপক্ষে ১০-১২টা গানের লিরিক শোনাবে।’ সবাই চলে গেলে আজাদ আসল। আমি বসেই ছিলাম। কথায় কথায় একদিন আজাদকে বললাম, ‘আজাদ তোর লেখা একটা লিরিকের সুর করি চল।’ সেই সুর করতে গিয়ে ঘন ঘন একসঙ্গে বসে মিউজিকের আড্ডা দিতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই আড্ডাটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল আমাদের। অন্য একদিন আজাদ সঙ্গে করে ওর এক ছোট ভাইকে নিয়ে এলো। নাম দ্বীপ। ভাল গিটার বাজায়। তো আমরা তিনজন বেশ জমিয়ে গিটার বাজাতাম, গল্প-গুজব করতাম, আড্ডা দিতাম, লিরিক নিয়ে আলোচনা করতাম। তার বেশ কয়েক দিন পর কথার প্রসঙ্গে একদিন আজাদ বলল, ‘চল একটা ব্যান্ড ফর্ম করি আমরা।’ আমি বললাম, ‘ব্যান্ড ফর্ম করা যায় কিন্তু আমরা তো মোটে তিনজন। আর তিনজনই গিটার প্লে করি। ভোকাল, ড্রামার এদের কই পাবি?’ আজাদ তাৎক্ষণিক এক বন্ধুর নাম মনে করল যে ড্রাম বাজানোর পাশাপাশি ভোকালও দিত। তো বেসিক্যালি এই ছিল আমাদের ব্যান্ডের একেবারে শুরুর দিকের কথা।’ কথা বলছিলাম মিরপুর রূপনগরের ব্যান্ড ডাকনামের গিটারিস্ট এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুশফিকের সঙ্গে। প্রত্যেকটা ব্যান্ড গড়ে ওঠার পেছনের গল্পটা সব সময়ই আড়ালেই থাকে। সবাই শুধু সাফল্যের কথাই শুনতে চায় কিন্তু সাফল্য লাভের জন্য যে ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প তা খুব কম মানুষই শুনতে চায় বা জানতে চায়। আজ ডাকনাম ব্যান্ডের সদস্যদের কাছ থেকে তাদের ব্যান্ডের গল্পগুলোই শুনব। তবে হ্যাঁ ব্যান্ডের শুরুটা হুটহাট করে হলেও ব্যান্ডের যাত্রাপথটা এতটা সহজসাধ্য ছিল না বলেই জানায় ব্যান্ডের সদস্যরা। ব্যান্ডের প্রধান ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বেইজিস্ট আজাদের সঙ্গে কথা হলে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় ব্যান্ডের নামকরণ নিয়ে। ‘আসলে দেখুন আমাদের সকলেরই একটা পরিচয় আছে। সবারই কিছু নিজস্ব ইচ্ছা বা কিছু করে দেখানোর নেশা থাকে। কিংবা কিছু ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকে বা অব্যক্ত কিছু কথা থাকে যা কখনও বলা হয় না। একটা সময়ে তা গভীরে তলিয়ে যায়। অনেক বছর পর হয়ত কেউ ওই কথা বা অনুভূতিগুলো নিয়ে নাড়া দিলে মনটা আন্দোলিত হয়, রোমাঞ্চিত হয়। এই যে আবেগটা, এই যে রোমাঞ্চটা এই ব্যাপারগুলোই মূলত আমরা ধরে রাখতে চাই। যাতে আমাদের ইচ্ছের চোরাচালান না হয়, যাতে সময়ের অজান্তে হারিয়ে না যায়। আর এই ধরে রাখাটাকে আমরা সুরের চিঠি বানাতে চাই। কিন্তু এই চিঠিগুলো যে আমরা মানুষের কাছে দেব তার জন্যও কিন্তু একটা নাম দরকার। একটা পরিচয় দরকার। তাই আমরা ‘ডাকনাম’ ‘ডাকঘর’কে প্রেরকের ঠিকানায় রেখে চিঠিগুলো পৌঁছে দিতে চাই প্রাপক হিসেবে পুরো বাংলাদেশের কাছে।’ ডাকনাম ব্যান্ডের পথচলা প্রায় অর্ধযুগেরও বেশি। এ্যালবাম করার ইচ্ছা কবে থেকে বা এত দেরি কেন এই ধরনের প্রশ্নে উত্তর দেয় ব্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য এবং ড্রামার অনল। ‘যে কোন ব্যান্ডেরই প্রথম ও প্রধান আশা থাকে তাদের নিজস্ব এ্যালবাম করা। তাদের করা সুর আর গানগুলো যেন মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। ডাকনামের ব্যতিক্রম নয়। এ্যালবাম করার ইচ্ছা শুরু থেকেই ছিল তবে নানাবিধ সমস্যায় দেরি হয়ে গেল। তবে দেরি প্রসঙ্গে আমাদের নিজস্ব একটা বিষয় শেয়ার করছি সেটা হলো আমরা একেকটা লিরিকের পেছনে, একেকটা সুরের পেছনে, একেকটা গানের পেছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছি। চেষ্টা করেছি নিজেদের সর্বোচ্চটা দিতে। আর দিয়েছিও তবে বাকিটা আপনাদের মানে শ্রোতাদের কাছ থেকে জানব।’ মূলত ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ‘ডাকনাম’ ব্যান্ডটি মূলত একটি রক ঘরানার ব্যান্ড। ডাকনাম ব্যান্ডের প্রথম এ্যালবামের নাম ‘নদী ও শহর।’ এই নামটা কেনই বা এই নামের বিশেষত্ব কি? ব্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভোকাল তন্ময় নিজে থেকে বিষয়টা সম্পর্কে জানায় আমাদের। ‘কিছুদিন আগে আমাদের এ্যালবামের কাজ চলাকালীন সময়ে এ রকম এক ইন্টারভিউতে বলেছিলাম আমরা গান লিখি জীবন থেকে। জীবনের গল্প নিয়েই তাতে সুর দিই। তাই আমাদের এ্যালবামের নাম হবে গানের চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখেই। তো ‘নদী ও শহর’ এ্যালবামের প্রথম গানটা ‘নদী’ দিয়ে শুরু হয়ে গ্রামের মেঠোপথের কিশোরীর হাসিমাখা মুখ, নাগরিক ভালবাসা, প্রেম, আনন্দ, বিষাদ সবকিছুকে সঙ্গে নিয়ে শেষ করবে ‘শহর’ গান দিয়ে। ভাবুন না একটা সময় আমাদের এই শহরটা শুধু নদীর ছিল। নদীটা নিজের বুক উজাড় করে শহরকে ভালবেসে জায়গা করে দিল আর শহরটা নিজের বুক ভারি করে আমাদের ঠাঁই দিল। আশা করি সবাই এইভাবে ভেবেই হারিয়ে যাবেন ‘নদী ও শহর’-এর সুরে।’ গত ২৩ মার্চ শুক্রবার বিকেল চারটায় ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে ব্যান্ড মিউজিক এক্সপ্রেসের পক্ষ থেকে এক উন্মুক্ত কনসার্টে রিলিজ হয়েছে ডাকনামের এ্যালবাম ‘নদী ও শহর’। এ কনসার্টে ব্যান্ড ডাকনামের সঙ্গে আরও থাকছে ব্যান্ড দূরবীন, ফ্রিড, ওয়ারসাইট, ব্যাসার্ধ, রিকার এবং তৃষ্ণার্ত। এ্যালবাম নিয়ে বিস্তারিত বলেন ব্যান্ডের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ও গিটারিস্ট দ্বীপ। প্রথম অবস্থায় আমাদের নিজস্ব স্টুডিও ডাকঘর এ গানগুলোর টেক নেয়া হয় তবে মাস্টার মিক্সিংয়ের জন্য স্টুডিও ভেলকির রোকন ইমন ভাইকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের গানগুলো লিরিক বেজড। সাবজেক্টিভ লিরিক নিয়ে কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমরা। আমাদের লিরিসিস্ট বেইজিস্ট আজাদ ভাই এবং মুশফিক ভাই। তাদের লেখা লিরিকগুলো জীবনের গল্প বলে অন্য ভাষায় যা আমরা গানে ফুটিয়ে তুলেছি অন্য সুরে। তাই, লিরিকের ভাঁজে আর সুরের খাজে একেকটা জীবনেরর গল্প দিতে চাই আমরা। প্রথম এ্যালবাম তাই খুব বেশি সময় নিয়েছি। যাচাই-বাছাই করেছি খুব বেশি। নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েছি বাদবাকিটা শ্রোতারা বলবে।’ মানুষ হয়ত তখনই খুব বেশি আশা আর বিশ্বাস নিয়ে সাফল্যের কথা বলে যখন তারা অনেকটা বাধাবিপত্তি ঠেলে নিজেকে উজাড় করে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। ‘ডাকনাম’ ব্যান্ডের সদস্যদের আশা আর বিশ্বাস সত্যিই মুগ্ধ করে। ‘নদী ও শহর’ এ্যালবামের গানগুলো যথাক্রমে নদী, রোমানা, ইচ্ছের চোরাচালান, দুঃস্বপ্ন, আহ্বান, বাঙালী, সাংবাদিক পরিবার, চোখ এবং শহর। ‘ডাকনাম’ ব্যান্ডের একটা ‘ডাকঘর’ আছে। ‘ডাকঘর’ হলো ডাকনাম ব্যান্ডের নিজস্ব স্টুডিও। এখানেই মূলত লিরিক, গানের সুর নিয়ে আলোচনা, গানের টেক বা মিক্সিং কিংবা বলা যায় ‘ডাকঘর’ হলো ডাকনামের গানগুলোর আঁতুড়ঘর। ‘ডাকনাম’ ব্যান্ডের সদস্যদের সঙ্গে আরও একবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ব্যান্ডের প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা- আজাদ (বেইজিস্ট এবং লিরিসিস্ট), গিটারিস্ট ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য- মুশফিক (লিরিসিস্ট), গিটারিস্ট-দ্বীপ (সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার), ড্রামার- অনল এবং ভোকাল- তন্ময়। সিডি ছাড়াও সব ধরনের অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই পাবেন ডাকনামের এ্যালবাম এবং গানগুলো। এ ছাড়াও ডাকনামের নিজস্ব ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল এবং ওয়েবসাইটেও পাবেন গানগুলো।
×