ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির দুশ্চিন্তায় উদ্যোক্তারা

এলএনজি আমদানির সব রকম প্রস্তুতি শেষ

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

এলএনজি আমদানির সব রকম প্রস্তুতি শেষ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আনতে প্রায় সব রকম প্রস্তুতি শেষ করেছে সরকার। মহেশখালীর কোয়ানক ইউনিয়নের ঘটিভাঙায় নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ পয়েন্ট। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে গভীর সমুদ্রে জাহাজ নোঙরের স্থানটিতে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বলছে, একেকটি এলএনজি ভর্তি জাহাজ থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেয়া হবে গ্রিডে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং প্রকৃত বিশ্লেষণ না করেই এলএনজি আমদানিতে নজর দিয়েছে সরকার। এর ফলে বোঝা বাড়বে দীর্ঘ মেয়াদে, মিলবে না বড় বিনিয়োগের সুফল। ক্যাপটিভ এবং শিল্পে এলএনজির ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, আমদানিকে সামনে রেখে এই দুই খাতে প্রায় দ্বিগুণ দাম বাড়ানো হলে ঝুঁকিতে পড়বে অর্থনীতি। সাপের মতো বেয়ে চলা মহেশখালী আর সোনাদিয়ার অসংখ্য বাঁক মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। কখনও মোহনা, আর কখনও বা সরু চ্যানেলের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা স্পিডবোটে দারুণ ব্যস্ত এক্সিলারেট এনার্জি আর জিওশানের কর্মীরা। কারণ এলএনজি আনতে এখনও বাকি বেশকিছু কাজ। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর স্পিডবোট মহেশখালীর কোয়ানক ইউনিয়নের ঘটিভাঙায়। সেখানেই গড়ে উঠেছে এলএনজির প্রথম টাই-ইন পয়েন্ট। মূলত তরলীকৃত গ্যাস নিয়ে সমুদ্রে ভাসতে থাকা জাহাজের সঙ্গে প্রথম সংযোগ ঘটবে এ পয়েন্টের। যেজন্য সমুদ্রের নিচ দিয়ে বসানো হয়েছে বিশেষ পাইপলাইন। আর এখান থেকে জাতীয় গ্রিডে দেয়ার জন্য শেষ হয়েছে আলাদা একাধিক পাইপলাইনের কাজও। যেগুলো করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিওশান। বিদেশ থেকে আসা এলএনজিভর্তি জাহাজটি অবস্থান করবে সমুদ্রের বেশ খানিকটা ভেতরে। যেখানকার গড় গভীরতা ৩২ থেকে ৩৫ মিটার। এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই, আবহাওয়া, ঝুঁকি এবং স্থায়িত্ব পরীক্ষার জন্য সেখানে রাখা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি জাহাজ। যেখানে নোঙর করবে এক্সিলারেট এনার্জির বিশেষ এফএসআরইউ। হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি এফএসআরইউতে এলএনজি থাকবে ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। যা সেখান থেকেই রূপান্তর করে গ্যাস পাওয়া যাবে ২৯০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখান থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট করে গ্যাস গ্রিডে দেয়া হলে একেকটি জাহাজে চলবে ছয় দিনের কম। আর, কাতার থেকে রওনা হয়ে এ পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে আরও দশ থেকে ১২ দিন। তাই নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ রাখতে হলে জাহাজ চলাচল ও নোঙরসহ কড়া নজরদারির আওতায় আনতে হচ্ছে সার্বিক ব্যবস্থাপনা। এ কার্যক্রম দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকার এলএনজি বাণিজ্যে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং প্রকৃত বিশ্লেষণ না করেই এলএনজি আমদানিতে নজর দিয়েছে সরকার। এর ফলে বোঝা বাড়বে দীর্ঘ মেয়াদে, মিলবে না বড় বিনিয়োগের সুফল। অবশ্য সরকার বলছে, এই কার্যক্রম বাংলাদেশকে হাজার কোটি ডলারের বৈশ্বিক বাণিজ্যের বড় অংশীদার করে তুলবে। যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক। আর এই উৎস ঘিরে সরবরাহ ব্যবস্থাকেও আরও আধুনিক করার ৃপরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ গ্রামটি এখন হাজার কোটি টাকার কর্মকা-ে মুখর। এসকেভেটর, রোলার আর বুলডোজারের ভারি আঘাতে নতুন রূপ পাচ্ছে প্রতি ইঞ্চি মাটিকণা। কারণ এখান থেকে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট পর্যন্ত বসানো হচ্ছে ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন। এই পাইপলাইনের মাধ্যমেই গ্রিডে দেয়া হবে বিদেশ থেকে এলএনজি হিসেবে আনা রূপান্তরিত গ্যাস। পরিকল্পনায় থাকা ২০৩০ সাল নাগাদ দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা গ্যাসের জন্যও অন্যতম বড় প্রকল্প এটি। এর বাইরেও সমান্তরালে বাস্তবায়িত হচ্ছে আরও কয়েকটি প্রকল্প। যা নিশ্চিত করবে এলএনজির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠতে। কারণ ২০১৬ সালের তথ্য হলো, সে বছর পুরো বিশ্বের গ্যাসের চাহিদার ১০ শতাংশই মিটেছে এলএনজি দিয়ে। আর বেচাকেনা হয়েছে প্রায় ২৬ কোটি টন। এই বিক্রির ত্রিশ শতাংশই সরবরাহ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। অস্ট্রেলিয়ার অংশও ছিল ১৭ শতাংশ। তবে এই গ্যাস কিনতে ৩৫টি আমদানিকারক দেশ প্রতি ইউনিটের জন্য সে বছর খরচ করেছিল সাড়ে পাঁচ ডলার। আর দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশকে তা এখন কিনতে হচ্ছে তিন ডলার বেশি দিয়ে। অথচ এই গ্যাস দেশে আসার কথা ছিল আরও অন্তত পাঁচ বছর আগে। যা সম্ভব হলে স্বস্তি মিলত দামের দিক দিয়েও। মূলত দামি জ্বালানি হিসেবে পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিত এলএনজি। যা ব্যবহারও করে থাকে শক্ত অর্থনীতির দেশগুলো। তাই এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কতখানি স্বস্তির সে প্রশ্ন উঠছে প্রায়ই। তাছাড়া এটি কোন খাতে কিভাবে, কতটুকু ব্যবহার করা হবে সে ব্যাপারেও নেই পরিষ্কার কোন রূপরেখা। প্রকৃত বিশ্লেষণ নেই, এটি আনতে কড়া বিনিয়োগ এবং তার বিপরীতে অর্থনৈতিক প্রাপ্তি নিয়েও। তাই কেউ কেউ মনে করেন, এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য হয়ে উঠতে পারে বড় বোঝা। ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বড় দুশ্চিন্তার জায়গা রয়ে গেছে দরদাম নিয়ে। ক্যাপটিভ এবং শিল্পে এলএনজির ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, আমদানিকে সামনে রেখে এই দুই খাতে প্রায় দ্বিগুণ দাম বাড়ানো হলে ঝুঁকিতে পড়বে অর্থনীতি। এমনকি বাংলাদেশ হারাবে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার সক্ষমতা। তাই লম্বা সময় নিয়ে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয়ের পরামর্শ তাদের। ম্যাকসন স্পিনিং মিলে দৈনিক ৬০ টন সুতা উৎপাদনের জন্য বিদ্যুত সংযোগ রয়েছে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। যার ৯ মেগাওয়াটই গ্যাস জেনারেট ভিত্তিক। এই জেনারেটর চালাতে মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে বিল দিতে হয় এক কোটি ত্রিশ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু এলএনজি যোগ হলে, বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৬২ পয়সার বদলে গ্যাস কিনতে হবে ১৬ টাকায়। ফলে তাদের মাসিক বিল বাড়বে অন্তত ৮৫ লাখ টাকা। যা প্রতি কেজি সুতার উৎপাদন খরচ ২৯০ থেকে বাড়িয়ে দেবে সাড়ে তিনশ টাকায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দামের দুশ্চিন্তা আরও ভোগাচ্ছে ক্যাপটিভের বাইরে থাকা অন্য শিল্প মালিকদেরও। কেননা এলএনজি দোহাই দিয়ে সেখানেও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ পৌনে আট টাকার বদলে কিনতে হবে প্রতি ঘনমিটার সাড়ে ১৬ টাকায়। এই দুই খাতে গ্যাসের মোট ব্যবহার তিন ভাগের একভাগ। যা দেশের কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং নতুন শিল্প গড়তে ভূমিকা রাখে সবচেয়ে বেশি। তাই উদ্যোক্তাদের পরামর্শ হলো দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও বাস্তবসম্মত হতে হবে সরকারকে। কেবল শিল্প কিংবা ক্যাপটিভ নয়, দামের বড় প্রভাব পড়বে বিদ্যুত খাতেও। কারণ সেখানেও সরকারের বাড়ানোর ইচ্ছা তিনগুণের বেশি। আর এটি করা হলে বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পৌনে তিন টাকার কমে পাওয়া প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে সাড়ে ৪ টাকা। ফলে বড় চাপ পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। এছাড়া সারের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত পৌনে পাঁচগুণ দাম বাড়লে ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়বে কৃষক পর্যায়ে। দাম বাড়ানোর বাইরে সরাসরি এলএনজি দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনেও সিদ্ধান্তও সমালোচিত নানা মহলে।
×