ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাস্টিন গোমেজ

হতে হবে সামাজিক

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

হতে হবে সামাজিক

সময়ের স্রোতে মানুষ আজ যতই আধুনিক হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা ততই প্রখর হচ্ছে। একক পরিবারের পরিবর্তে অনু পরিবার গঠনের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। যার ফলে সামাজিকীকরণ বিলুপ্ত প্রায়। সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও ভাবধারা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। সমাজবিজ্ঞানী ইড়মধৎফঁং-এর ভাষায়, ‘সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি জনকল্যাণের নিমিত্তে একত্রে নির্ভরযোগ্য আচরণ করতে শেখে এবং এটি করতে গিয়ে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্বশীল ও সুসামঞ্জস্য ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করে।’ অর্থাৎ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ সমাজে প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও ভাবধারা ইত্যাদি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সামাজিকীকরণের প্রধান ক্ষেত্র হলো পরিবার। পারিবারের শিক্ষা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি সন্তানদের পরবর্তী জীবনে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের সমাজে যখন যৌথ পরিবার ছিল তখন পরিবারেই সন্তানেরা সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করত। নানামুখী অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা পেত। বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে তারা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার শিক্ষা পেত। সমাজের সঙ্গে তার যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সেই উপলব্ধি জন্মাত পরিবারেই। নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও সামাজিক মূল্যবোধের ধারণা লাভ করে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হতো। তাদের মধ্যে জন্ম নিত সামাজিক দায়বদ্ধতা। বর্তমানে বাংলাদেশে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদের সঠিকভাবে সামাজিকীকরণ হচ্ছে না। অত্যাধুনিক চিন্তাচেতনার বেড়াজালে বেড়ে উঠতে গিয়ে বর্তমান প্রজন্ম সঠিক পথ পরিহার করে বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় কিন্তু ব্যর্থ হবে। ভেঙ্গে যাবে সামাজিক কাঠামো। সামাজিক অস্থিরতা, পারস্পরিক সহিংসতা ও সন্ত্রাস, দুর্নীতি, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলবে। ভুলে গেলে চলবে না যে যে সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ের সরাসরি সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠে তাদের মধ্যে বাবা-মায়ের আদর্শ, বাবা-মায়ের সম্পর্ক ও নৈতিকতার প্রকাশ, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি কিছুর একটা প্রভাব পড়ে। তাই বাবা-মার উচিত তাদের সামনে সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সন্তানের জন্য মা-বাবার যতœ ও সচেতনতার যেন কোন ঘাটতি থাকে না। শিশুকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা মা-বাবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ভুল করলে হাসিমুখে শুধরে দিন। সঠিকভাবে করতে পারলে প্রশংসা করুন। ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কৃত করুন। এতে শিশু দ্রুত সফল হবে এবং নিজের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। পরবর্তী সময়ে নতুন কাজের প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে। নিজের কাজ ছাড়াও পরিবারের অন্যদের কাজে সাহায্য করতে শিশুকে উৎসাহ দিন। এতে সে আনন্দিত হবে এবং নিজেকে দায়িত্বশীলও মনে করবে। বকা দেবেন না। বকাঝকা করলে বা বিরক্তি প্রকাশ করলে শিশু কাজের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। নিজের প্রতি অনাস্থা ও হীনম্মন্যতা তৈরি হতে পারে। শিশুর মনে হতে পারে যে তাকে দিয়ে কিছু হবে না। যা শিশুমনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বরং ধৈর্য নিয়ে শিশুর পাশে থেকে তাকে সহযোগিতা করুন। শিশুকে শেখাতে গিয়ে কখনই অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। এ ধরনের কথা শিশুর বিকাশে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের বুঝতে হবে তারাই আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তাদেরই রক্ষা করতে হবে। আধুনিকতার নামে সংস্কৃতির সকল নতুন উপাদানের সঙ্গে গা ভাসিয়ে নিজের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের স্বাতন্ত্র ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলব। সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্মান-শ্রদ্ধার মাধ্যমেই পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে সংস্কৃতি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সামাধান করতে হবে। তাহলেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর আমাদের পরিবারগুলো পরিণত হবে শান্তির নীড়ে। আর এই শান্তির নীড় থেকে তখন বের হবে জাতির জন্য আদর্শবান নেতৃত্ব। নটর ডেম কলেজ, ঢাকা থেকে
×