ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাউফলে বাবা-মার কবরের পাশে চির শয়ানে রাজীব

রাজীবের দুই ভাইয়ের শিক্ষার দায়িত্ব নেবে সরকার

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

রাজীবের দুই ভাইয়ের শিক্ষার দায়িত্ব নেবে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাত হারানোর পর নিহত তিতুমীর সরকারী কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের দুই এতিম ভাইয়ের শিক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব নিচ্ছে সরকার। রাজীবের দুই ভাইকে মিরপুরের শিশুপল্লীতে রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য রাজীবের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন বলে জানিয়েছেন চীফ হুইপ ফিরোজ। এদিকে দ্বিতীয় দফায় নামাজে জানাযা শেষে রাজীবকে তার নানার বাড়িতে পিতা-মাতার পাশে দাফন করা হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য রাজীবেরও ভুল থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রাজীবের দুই ভাই তার ভাই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছে। বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, নিহত রাজীবের দুই ভাইয়ের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে চায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাজীবের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। রাজীবের পরিবার রাজি হলে তার এতিম দুই ভাইকে মিরপুরের শিশুপল্লীতে রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। সব ধরনের চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। রাজীবের দুই ভাই যাত্রাবাড়ীর মীর হাজীরবাগের তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় (এতিমখানা) পড়াশোনা করে। ইতোমধ্যেই সমাজকল্যাণ অধিদফতরের মহাপরিচালক রাজীবের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শুধুমাত্র এসএসসি নয়, পরবর্তী লেখাপড়া চালানোর ক্ষেত্রেও মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালন করতে রাজি। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার, দর্জির কাজসহ হাতের অন্যান্য কাজ শেখানো হবে তাদের। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসিত করা হবে। এদিকে বুধবার সকালে ঢাকার হাতিরঝিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম দেখার সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সঙ্গে রাজীবেরও ভুল থাকতে পারে। হাতটি হয়তো বাইরে না রাখলে এতবড় দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। চালকদেরও দোষ থাকার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট। চালকদের আরও সচেতন হতে হবে। বুধবার বেলা এগারোটায় রাজীব হোসেনের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বাউফল উপজেলা পাবলিক মাঠে। জানাজা শেষে দাশপাড়ায় নানা লাল মিয়ার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে পিতামাতার পাশে রাজীবকে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, জেলা প্রশাসক মাছুমুর রহমান, পুলিশ সুপার মঈনুল হাসান, বাউফলের ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মাহামুদ জামানসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং এলাকাবাসী। রাজীবের দুই ভাই ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন বলে জানিয়েছেন চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। জেলা প্রশাসক জানান, সমাজসেবা ও ত্রাণ তহবিল থেকে রাজীবের পরিবারকে ৪৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। গত ৩ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে বাংলামোটর থেকে ফার্মগেটের দিকে যাওয়া একটি দোতলা বিআরটিসি বাস কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশে সিগন্যালে থামে। একই দিক থেকে আসা স্বজন পরিবহনের একটি বাস দ্রুতগতিতে দু’তলা বাসটির পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিআরটিসি বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল রাজীব (২২)। স্বজন পরিবহনের বাসটি যাওয়ার চেষ্টা করায় দুই বাসের মধ্যে ঘর্ষণ হয়। তাতেই রাজীবের ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে দু’তলা বাসের সঙ্গে ঝুলে থাকে। রাজীবকে প্রথমে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ৯ এপ্রিল প্রায় তেরো দিন পর রাজীবের মৃত্যু হয়। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রাজীবের মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসকরা জানান। ক্ষতিপূরণ হিসেবে এককোটি টাকা দিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। রাজীবের খালা জাহানারা বেগম জানান, রাজীব অল্প বয়সেই এতিম হয়। মতিঝিলে তার বাসায় থেকেই পোস্টাল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। আর পুরনো ঢাকায় অবস্থিত সরকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এরপর তিতুমীর সরকারী কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে পড়ছিল। রাজীব টিউশনি করে এবং একটি কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করে ছোট দুইটি ভাইয়ের খরচ যোগাত। দুই ভাই যাত্রাবাড়ী তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় (এতিমখানা) পড়ছে। মেহেদী হাসান সপ্তম শ্রেণীতে আর হৃদয় হাসান আব্দুল্লাহ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। রাজীবের দুইটি ভাইয়ের জন্য সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন হৃদয়বান ব্যক্তি যদি বাসস্থানের ব্যবস্থা করে তাহলে দুইটি ভাই চিরদিনের জন্য নিশ্চিন্ত হতে পারবে। রাজীবের সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রধরে দায়েরকৃত মামলার দুই আসামি বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন পরিবহনের বাসের চালক খোরশেদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। রাজীবের ভুলের কথা বলিনি কাদের ॥ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলার সময় ঢাকার রাজীব নয়, গোপালগঞ্জের হৃদয় মিনারের ভুলের কথা বলেছিলেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বুধবার সকালে এফডিসির সামনে তার দেয়া বক্তব্য ধরে ‘রাজীবও ভুল করতে পারে’ বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের প্রেক্ষাপটে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে বিভ্রান্তির অবসান ঘটান তিনি। কাদের বলেন, ‘ওই যে হেলপার ছেলেটি, হৃদয়ের নাম আমার তাৎক্ষণিকভাবে মনে আসেনি। হৃদয়ের ঘটনাকে বলেছি, তারও ভুল হতে পারে। রাজীবের বিষয়টা আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, গাড়ির রেষারেষি, ওভারটেকিং এবং কার আগে কে যাবে, প্রতিযোগিতায় এই ছেলেটির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।’ রাজীবের মৃত্যুর পরদিন সকালে নাম উল্লেখ না করে মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের বেশিরভাগ তা এই কলেজছাত্রের বলে ধরে নিয়েছিলেন। ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি গঠনমূলক সমালোচনা করি। কিন্তু যা বলিনি, সেটা যদি আমার নামে চালানো হয়, এই বিষয়টা মেনে নেয়া খুব কঠিন। আমি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আমার ভুল হলে স্বীকার করব। কিন্তু এইখানে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলছি, আমি রাজীবকে তার ভুলের জন্য দায়ী করে কোন কথা বলিনি। আমি আশাকরি, এ নিয়ে বিভ্রান্তির অবসান হবে।’
×