ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ে বর্ষবরণে জল উৎসব

হৃদয়ের কথা বলার অপূর্ব সুযোগ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

হৃদয়ের কথা বলার অপূর্ব সুযোগ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস

এইচ এম এরশাদ ও মোহাম্মদ আলী ॥ রাখাইন সম্প্রদায়ের বৃহত্তম সামাজিক উৎসব সাংগ্রোং পোয়ের অন্যতম আকর্ষণ কক্সবাজার জেলার জলকেলি বা পানিখেলা অনুষ্ঠান শেষ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। মঙ্গলবার দুপুরে বৌদ্ধ মন্দিরের কেন্দ্রীয় জলকেলি প্যান্ডেলে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্যথিং অং। এরপরই রাখাইন পল্লীর ২০টি প্যান্ডেলে সানন্দে শুরু হয় জলকেলি উৎসব। শহর ছাড়াও মহেশখালী, টেকনাফ, চৌধুরীপাড়া ও চৌফলদ-ীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ৩ দিনব্যাপী চলে এ অনুষ্ঠান। রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষ-পঞ্জিকা অনুসারে ‘১৩৭৯ মগীসন’কে বিদায় জানিয়ে ১৩৮০ মগীসনকে বরণ করার জন্য রাখাইন সম্প্রদায় প্রতিবছর এদিনে নববর্ষ পালন করে। এদিকে, বুধবার রাঙ্গামাটি শহরের ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ের মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই জল উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। শহরের আসামবস্তি নারিকেল বাগান এলাকায় মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) আয়োজিত অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। জানা যায়, কক্সবাজারে রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব ‘মাহা সাংগ্রেং পো-ওয়ে’ উদ্যাপনের মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানায় তারা। সাংগ্রেং উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপভোগ্য উৎসব রাখাইন কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের পানিখেলার অনুষ্ঠান (রিংলং পো-ওয়ে)। আগে থেকে তরুণ-তরুণীরা বিশেষ আকারে তৈরিকৃত প্যান্ডেলে নানা ধরনের সতেজ ফুল, বাহারি পত্র-পল্লব ও বর্ণিল বেলুন দিয়ে প্যান্ডেল শোভিত করেছে। কক্সবাজারে আকর্ষণীয় প্যান্ডেলসমূহে লাল রঙ্গের কৃষ্ণচূড়ার ফুল ও মেয়েরা নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে একই রঙের বিভিন্ন পোশাক পরিধান করেছে। যা দেখে প্যান্ডেলের তরুণীরা পানিখেলার জন্য আগত বিভিন্ন তরুণদের সহজে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ওসব প্যান্ডেলে পানি রাখার জন্য রাখা হয়েছে বড় বড় পাত্র বা ড্রাম। পুরনো বছরের পাপ পঙ্কিলতাকে জল দিয়ে ধুয়ে মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দের বহিঃপ্রকাশই রাখাইনদের সাংগ্রেং উৎসব। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার শহরে অনুষ্ঠিত জলকেলির বিভিন্ন প্যান্ডেলে ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইন তরুণ-তরুণীদের এ যেন এক মহাআনন্দ উৎসব। গেল বছরের দুঃখকষ্টের কথা ভুলে গিয়ে অনাগত দিনের সুখ-সমৃদ্ধির আশা রেখে আনন্দ লাভের সুযোগ ও উপায় হচ্ছে এ অনুষ্ঠানের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। তাদের মতে, অনেকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে প্রতিবছর রাখাইনরা মহাধুমধামের সঙ্গে এই উৎসব পালন করে থাকে। ৩ দিনের এই সুবর্ণ সুযোগে তরুণ-তরুণীদের অবাধে কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। এক কথায়-রাখাইন প্রেমিক-প্রেমিকাদের এ যেন একেবারে চাঁদের হাট। দেখা মাত্রই কোন রকম আড়ষ্ট না হয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে চলেছে তারা একে অপরকে। এতদিন সামাজিক ও পারিবারিক বলয়ের কারণে নিজের প্রিয়জনকে কিছু বলতে চেয়েও তাদের মনের কথা বলার সুযোগ গড়ে ওঠেনি। জলকেলি বা পানিখেলার সময় কাক্সিক্ষত ওই সুযোগটি অনায়াসে পেয়ে থাকে তারা। রাখাইন তরুণ-তরুণীদের এভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে দেখে এবং সর্বোপরি জলকেলির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেকে উৎসবোত্তর তাদের মধ্যে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় এই ভ্রান্ত ধারণা করতে পারে। কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে তৈরি একই প্যান্ডেলে যারা কিছুক্ষণ জলকেলি উৎসব উপভোগ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন, তারা অবশ্য দেখতে পেয়েছেন বিভিন্ন দলের তরুণ একজন তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছে এবং জলকেলিতে অংশ নিয়েছে। আনন্দের আতিশয্যে নেশা জাতীয় পানীয় পান করে পাশ্চাত্যের ঢঙে ডিসকো ও ব্রেক ড্যান্স করে উপস্থিত সকলকে মাতিয়ে রাখে রাখাইন তরুণীরা। তাছাড়া শিশু-কিশোর ও ছেলে-মেয়েরা ছোট্ট বালতি কিংবা পানি ছিটানোর অত্যাধুনিক নানা যন্ত্র দিয়ে পরিধেয় কাপড় ভিজিয়ে দেয়। তাদের রাখাইন পল্লীর অলি-গলিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকতে দেখা গেছে। যখন অভেজা লোক পায়-তখনই তারা জল ছুড়ে ভিজিয়ে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করেছে। বুধবার শহরের বিভিন্ন রাখাইন পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইনদের তৈরি প্যান্ডেলগুলোতে তরুণীরা নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে বসে রয়েছে। রাখাইন তরুণরা নানা ধরনের উল্লাস-ধ্বনি ‘লে: লে: মংরো, মংরো’ করে একটির পর একটি প্যান্ডেলে গিয়ে জলকেলিতে অংশ নিচ্ছে। তরুণের দল প্যান্ডেলে আসলে-তরুনীরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে জলকেলিতে কে সঙ্গী হবে ? এ ধরনের কোন নিয়ম-নীতি নেই বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েল ফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় নেতা ইউ ক্য থিং। তিনি জানান, তরুণীদের জন্য নির্ধারিত প্যান্ডেল আছে বলে তারা অন্য কোন প্যান্ডেলে যেতে পারে না। তরুণরাই প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গিয়ে নিজেদের সমঝোতার মাধ্যমে সঙ্গী ঠিক করে নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সুুযোগ-সুবিধা একটু বেশি থাকে বৈকি। কেননা কোন ছেলে যে কোন মেয়েকে আমন্ত্রণ করলে ওই মেয়েকে অবশ্যই জলকেলিতে তার সঙ্গী হতে হয়। কোন মেয়ে ওভাবে কোন ছেলেকে কোনক্রমেই আমন্ত্রণ করতে পারে না। কার্যত ছেলেদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেয়েরা সম্মত হয় বলে ছেলেরা নিজ নিজ পছন্দমতো মেয়েকে সঙ্গী করে থাকে। কক্সবাজারের রাখাইন পল্লীগুলোতে অনুষ্ঠিত জলকেলি উৎসবের দৃশ্য সকল সম্প্রদায়ের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। শহরের হাঙ্গরপাড়া, পশ্চিম টেকপাড়া, চাউলবাজার সড়ক, পূর্ব মাছবাজার, পশ্চিম মাছবাজার ও ক্যাং পাড়াসহ বিভিন্ন প্যান্ডেলে উপভোগকারী ব্যক্তিরা ঘুরে ফিরে দেখছেন। রাখাইনদের ওসব প্যান্ডেলে জলকেলি অনুষ্ঠান ছাড়াও আলোচনা সভা, প্রীতিভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন রয়েছে। এ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ রাখাইন সম্প্রদায়ের দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছেন। রাখাইনদের জলকেলি অনুষ্ঠান ও আনন্দ উৎসব কক্সবাজারে পরিণত হয়েছে সর্বজনীন লোকজ উৎসবে। রাখাইনদের সকল বয়সী নারী-পুরুষের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনও ওই উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে দেখা গেছে। কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতা অধ্যক্ষ ক্যথিং অং বলেন, চৈত্র সংক্রান্তি থেকে রাখাইনদের বর্ষবরণ ‘সাংগ্রেং পোয়ে’ উৎসব শুরু হয়ে চলে প্রায় সপ্তাহ জুড়ে। উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ‘পানিখেলা’ বা ‘জলকেলি’ উৎসব। আদিকাল থেকে রাখাইন নববর্ষ উপলক্ষে সামাজিকভাবে সাংগ্রেং পোয়ে উৎসব পালন হয়ে আসছে। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আনন্দ-উল্লাসে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে সবাই। এর মাধ্যমে আমরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরনো দিনের সব ব্যথা, বেদনা, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এটি আমাদের কাছে খুবই পবিত্র ও উৎসবের দিন। মারমাদের জল উৎসব ॥ রাঙ্গামাটি শহরের বুধবার ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ের মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই জল উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। শহরের আসামবস্তি নারিকেল বাগান এলাকায় মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) আয়োজিত অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফিরোজা বেগম চিনু এমপি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা, রাঙামাটি রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম ফারুক প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সরকারী বেসরকারী, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, মারমা সংস্কৃতি সংস্থার (মাসস) প্রধান উপদেষ্টা, জল উৎসব কমিটির আহ্বায়কসহ অন্য অতিথিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠান হয়েছে। আলোচনা সভা শেষে অতিথিবৃন্দ জল উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর বাঁশি বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী জল উৎসব। তখন পানি ছিটিয়ে একে অপরকে ভিজিয়ে দেয়। তারা মনে করেন পুরাতন বছরের সব গ্লানি এই পানি ছিটানের মধ্য দিয়ে ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে যায়। মারমারা সাংগ্রাই উপলক্ষে অত্যন্ত ঘটা করে এই উৎসব পালন করে থাকে।
×