ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরা ও পূর্বাচলে ধৃত অস্ত্রের চালান কি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের?

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

উত্তরা ও পূর্বাচলে ধৃত অস্ত্রের চালান কি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের?

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর উত্তরা ও পূর্বাচলে উদ্ধার হওয়া কয়েক কোটি টাকা মূল্যের অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এনেছিল বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। দেশে বড় ধরনের নাশকতার চক্রান্ত নিয়ে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে। বড় ধরনের আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান কোন জলাধারের পানির নিচে লুকানো অবস্থায় মজুদ আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান এনে মজুদ করার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। বড় ধরনের দুটি অস্ত্র ও গোলাবারুদ চালানের মাফিয়া ডন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় রহস্য রয়েই গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কে বা কারা কোথা থেকে, কিভাবে এনেছে এবং গন্তব্য কোথায় ছিল তার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরায় অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান উদ্ধারের এক বছরের মাথায় পূর্বাচলে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। রাজধানীর উত্তরা ও পূর্বাচলের দুটি অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানই জলাধারের পানির নিচ থেকে উদ্ধার হয়। রাজধানী ও দেশের বিভিন্নস্থানে বড় ধরনের নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালনার উদ্দেশে মজুদ করা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়ায় চোরাচালানচক্রের মাফিয়া ডন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ২০১৭ সালের জনে রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ রূপগঞ্জের পূর্বাচল ৫ নম্বর সেক্টরের জলাধার থেকে উদ্ধার করা বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান কোথা থেকে আনা হয়েছে, গন্তব্য কোথায়, মালিক কারা তা এখনও রহস্যাবৃত। তবে পূর্বাচলের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের এক বছর আগে ২০১৬ সালে উত্তরায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের সঙ্গে পূর্বাচলের জলাধারে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। উত্তরার অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের তদন্ত যেভাবে ডীপ ফ্রিজে চলে গেছে পূর্বাচলের অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালানের তদন্তের পরিণতি কি একই পথে এগোচ্ছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পূর্বাচলের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচ আসামির কেউই অস্ত্র ও গোলাবারুদের মালিক কিংবা আনা-নেয়ার সঙ্গে জড়িত নয়, তা নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ কারা, কি উদ্দেশে জলাধারে এনে রেখেছিল সে রহস্য উদঘাটিত না হওয়ায় তদন্তে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুনে উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ির একটি খাল থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকের উৎস ও গন্তব্য এখনও তদন্ত করে বের করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর রূপগঞ্জের পূর্বাচল প্লটের খালে মিলল আরও একটি বড় অস্ত্রের চালান। গ্রেফতার হওয়া এক মাদক ব্যবসায়ীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ চালানের সন্ধান মেলে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামের জেটি থেকে দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের পর এবার আবারও একসঙ্গে এত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। রূপগঞ্জ ও দিয়াবাড়ির ঘটনায় অনেক দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। ২০১৬ সালের জুনে উত্তরার দিয়াবাড়ির খাল থেকে উদ্ধার করা বিপুল অস্ত্র কারা,ইক কারণে, কোন্ উদ্দেশে ফেলে রেখেছিল তার তদন্ত কার্যত এখন থমকে আছে। সুনির্দিষ্ট ক্লু বের করতে না পারায় অস্ত্রের চালান উদ্ধারের এ ঘটনার তদন্তে কোন সুরাহা হয়নি। তদন্ত যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, দিয়াবাড়িতে যে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল, তার সঙ্গে রূপগঞ্জের উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনার মিল থাকায় দুটি স্থানে একই কৌশলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখার বিষয়টি পরিষ্কার। একই অস্ত্র চোরাচালান চক্র এর পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কেন-কারা, কি কারণে এসব অস্ত্র রূপগঞ্জের খালে মজুদ করেছিল তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের কারণে দুর্বৃত্তরা অস্ত্রগুলো ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলো আনার পেছনে আন্তর্জাতিক ও দেশী চক্রান্ত থাকতে পারে। দিয়াবাড়ির অস্ত্রের চালান উদ্ধারের পর রহস্য উদ্ঘাটনে একটি কমিটি গঠন করে ডিএমপি। তবে তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় কমিটির প্রতিবেদনে তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নেই। জানা গেছে, মাছ ধরতে গিয়ে এ অস্ত্রের সন্ধান পায় গ্রেফতাররা। কিন্তু তারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে না জানিয়ে অবৈধভাবে এগুলো বেচাকেনার চেষ্টা করছিল। ডোবা থেকে একটি ব্যাগের আটটি অস্ত্র তারা নিজেদের কাছে লুকিয়েও রেখেছিল। এ জন্যই মূলত তারা ফেঁসে গেছে। তা ছাড়া গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অভিযোগ রয়ে গেছে। পুলিশ পাঁচ আসামিকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। শরীফ খান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব অস্ত্র-গোলাবারুদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরপর শাহীন ওরফে সানা, শান্ত, রাসেল ও মুরাদ নামে চার যুবককে গ্রেফতারের কথা জানায় পুলিশ। পাঁচ আসামির হেফাজত থেকে আটটি অস্ত্র পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় অস্ত্র মামলা। গ্রেফতারদের এক বছর আগে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। হৃদয় নামে এক যুবক পূর্বাচলের ওই জলাধারে মাছ ধরতে গিয়ে একটি ব্যাগের সন্ধান পায়। সে বিষয়টি মুরাদ, শাহীন, শান্ত ও রাসেলকে জানায়। তারা বিষয়টি শরীফকে জানায়। শরীফসহ সবাই মিলে সেই ব্যাগ তুলে দুটি অস্ত্র পূর্বাচলের এক স্থানে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে। একটি শরীফের হেফাজতে রাখে। বাকি ৫ অস্ত্র মুরাদ নিজের কাছে রাখে। জলাধারে অভিযানের আগেই পুলিশ শরীফ ও অন্যদের হেফাজতে থাকা তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করে। আর মুরাদের কাছে থাকা বাকি পাঁচটি অস্ত্র শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২ জুন সকাল থেকে পূর্বাচলের ওই জলাধারে অভিযান চালিয়ে ৬১ চায়নিজ এসএমজি, ২ রকেট লঞ্চার, ২ ওয়াকিটকি, ৭.৬২ বোরের ৫ পিস্তল, ৫ পিস্তলের ম্যাগজিন, ৪৯ রকেট লঞ্চার প্রজেক্টর, ৪২ হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএমজির ম্যাগজিন ৪৪, বিপুল টাইমফিউজ, ইগনাইটার, গুলি ও ব্যাজ উদ্ধার করা হয়। অনুরূপভাবে ২০১৬ সালে রাজধানীর উত্তরায় এর চেয়েও বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে; যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এই ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীরই, যারা একসময় বাংলাদেশে বসে তাদের নিজের দেশে কর্মকা- চালাত। ওই গোষ্ঠীটির নেতা-কর্মীরা গোপনে এ দেশে অবস্থান করতেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিচ্ছিন্নতাবাদীর ঘাঁটি উচ্ছেদ করে। এখন আবার এই ধরনের কোটি কোটি টাকা মূল্যের অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান কারা-কি উদ্দেশে, কোথা থেকে এনেছে ও গন্তব্য কোথায় তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের পুরো চালানটি কোথা থেকে আনা হয়েছে, কোথায় গন্তব্য, মালিক বা মাফিয়া ডন কে বা কারা, কোন্ পথে চালানটি এসেছে সে বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত।
×