ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করুন ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করুন ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন থেকে ॥ নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, বার বার তার প্রাণনাশের চেষ্টাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ও অর্জনের কথা কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রের সরকার ও প্রধানদের শোনালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অর্জনের পাশাপাশি কমনওলেথ সম্মেলনেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি জোরালো ভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি। রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ, টেকসই ও দ্রুত সমাধানেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যাশার পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর এ ব্যাপারে আরও চাপ সৃষ্টি করারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকেলে লন্ডনে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও মানবিক ইস্যুতে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (ওডিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প ঃ নীতি, অগ্রগতি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক সেমিনারে কিনোট স্পীকার হিসাবে মূল বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের আমলে ব্যাপক সাফল্য ও অগ্রগতি তুলে ধরার পাশাপাশি দেশ ও দেশটির জনগণের সার্বিক ভাগ্যোন্নয়নে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ওডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক এ্যালেক্স থিয়ের। মূল বক্তব্য এবং পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে মিয়ানমার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যকর ও বাস্তব কোন কিছুই করছে না। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি, চুক্তি হয়েছে এবং তারা সম্মত হয়েছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার তাদের নাগরিক উদ্বাস্তু ফিরিয়ে নিতে কার্যকর কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, সেটাই সমস্যা। সম্প্রতি একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে রয়টার্সের এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্ডার লাইনে অর্থাৎ জিরো পয়েন্টে অনেক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রয়েছে। মিয়ানমার সেখান থেকে একটা পরিবারের অর্ধেক নিয়েছে, কিন্তু ক্যাম্প থেকে নেয়নি। এসব পরিবারের সদস্য ক্যাম্পেই রয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার সম্ভবত বিশ্বকে দেখাতে চাইছে তারা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়া শুরু করেছে। এটা ভোল লক্ষণ। কিন্তু একটা পরিবার কেন? আমরা তাদের ৮ হাজার পরিবারের তালিকা দিয়েছি, কিন্তু তারা তাদের ফিরিয়ে নেয়নি। কারণ তারা দেখাতে চায় ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। তবে মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া পুরোদমে শুরু করা। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যখন আলোচনা করছি তখন মিয়ামনার দেখাচ্ছে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। তবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে, আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করছে না। এজন্য মিয়ামারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও চাপ তৈরি করতে হবে। যাতে মিয়ানমার শীঘ্রই তাদের রোহিঙ্গা নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়। দেশের উন্নয়নের গল্প শোনালেন প্রধানমন্ত্রী ॥ সদ্য জাতিসংঘ থেকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটাই প্রথম কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান। তাই কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে দেশের ব্যাপক এই উন্নয়ন সাফল্য অর্জনে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আগের মতো বিদেশীদের কাছে কিছু চাইতে নয়, বরং বাংলাদেশও যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেই বাস্তব সত্যের গল্পকথাও সাবলীলভাবে বিশ্ব নেতাদের জানিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কমনওয়েলথ নেতৃবন্দকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আপনাদের আগ্রহ দেখে আমি দারুণভাবে উৎসাহিত। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। এই স্বপ্নই আমাদের সরকারের পথ চলার প্রধান পাথেয়। তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে আমি দেশে ফেরার পর থেকে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ভোট-ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করি। এই আন্দোলন করতে গিয়ে বার বার আমাকে নিশানা বানানো হয়েছে, আমার জীবন নাশের জন্য ১৯ বার হামলা করা হয়েছে, বহুবার গ্রেফতার হয়ে জেল খাটতে হয়েছে। আজকের স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে আমার সংগ্রামের এটিই হলো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তিনি বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকার পর আবার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এ সময় দেশকে মোকাবেলা করতে হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চরমপন্থার উত্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দীর্ঘমেয়াদী বৈশ্বিক মন্দা এবং পণ্যের আন্তর্জাতিক উচ্চ মূল্য। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে আমাদের ইশতেহারে ভবিষ্যত বাংলাদেশের রোডম্যাপ ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করি। অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ইশতেহারের মূল দর্শনও ছিল ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমরা দীর্ঘ, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প মেয়াদী নীতি গ্রহণ করি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়ে আমরা ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করি। গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সরকার ক্ষুদ্র ঋণ ফান্ডের ব্যবস্থা করে। খাদ্যে উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে আমরা কৃষির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেই। আমাদের দৃঢ় সংকল্প ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দেশের উন্নয়নে সফলতা এনে দেয়। আমরা শস্য, মাছ, পোল্ট্রি এবং সবজি উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করি। আমরা রাজস্ব আদায়ে দেশীয় সম্পদের ওপর গুরুত্ব দেই। আমাদের জাতীয় বাজেটের ৯৫ শতাংশই আসে দেশীয় সম্পদ থেকে। সরকার প্রধান আরও বলেন, আজকে বিশ্বে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গত বছর আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং এ বছর ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে জিডিপি ১০০ বিলিয়ন ডলার থেকে আড়াইগুণ বেড়ে ২৫০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯ গুণ বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালে ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে এ বছর ১ হাজার ৭৫২ ডলার হয়েছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারী দেশ। আমাদের এখন লিড (লিডারশিপ ইন এনার্জি এ্যান্ড এনভারনমেন্ট ডিজাইন) সনদপ্রাপ্ত ৬৭টি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ সাত পরিবেশ বান্ধব গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল কারখানাও বাংলাদেশে। বাংলাদেশে স্বল্পতম সময়ে প্রযুক্তির বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের ১৩৬ মিলিয়ন মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এবং তাদের মধ্যে ৭৩ মিলিয়ন মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বিলিয়ন ডলারের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের সম্প্রাসারণে ১৩টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। শীঘ্রই বাংলাদেশ প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু -১’ উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। এছাড়া আমরা ৬ হাজার ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেছি এবং সাড়ে আট হাজার ই-পোস্ট অফিস সেন্টার স্থাপন করেছি, যেখান থেকে মানুষ ২০০ ধরনের সেবা পেয়ে থাকে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৌশলগত অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক যোগাযোগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক আউটসোর্সিং-এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদীয়মান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নেই সোয়া ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। এছাড়া আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করছি যেখানে আমাদের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, আঞ্চলিক সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ হতে পারে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মানুষের মার্কেটে প্রবেশদ্বার। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন) ভুক্ত দেশগুলোর মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়াতে বহুমুখী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেকার পুরাতন সিল্করোড পুনরায় চালুর মাধ্যমে আমরা প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও চীনের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া বে অব বেঙ্গল মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল এ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশেন (বিমসটেক) আসিয়ান দেশগুলোকে যুক্ত করেছে। তিনি বলেন, আমাদের বৈদেশিক নীতিই হচ্ছে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শক্তিশালীকরণ বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে। তবে আমাদের বিশাল অর্জন বিনা চ্যালেঞ্জে এসেছে তা কিন্তু নয়। সফলতা অর্জনে আমাদের নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। সবচেয়ে কম দূষণকারী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সমুদ্র লেভেল সামান্য বাড়লে আমাদের লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বে। আমাদের পৃথিবী, জীব বৈচিত্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন রক্ষা করার দায়িত্বও বিশ্ব সম্প্রদায়কে ভাগ করে নিতে হবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর ধকল সইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিশ্ব নেতারাও এ বিষয়ে অনেক কিছু করেছেন। বাংলাদেশ এই সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ, টেকসই এবং দ্রুত সমাধান চায়। আর পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও উদ্ভাবনী অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী ও উন্নত জাতি গঠনে আমরা ‘ভিশন ২০৪১’ গ্রহণ করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নির্ধারিত সময়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ থাকা তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
×