ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের ফ্রাঞ্জাইজিভিত্তিক লীগে ফের সেতু এফসির সঙ্গে চুক্তি বাংলাদেশের কৃতী স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুনের, অপেক্ষায় আরও অনেকে

সাবিনা-কৃষ্ণার সাফল্যে অন্যদেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

সাবিনা-কৃষ্ণার সাফল্যে অন্যদেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা

রুমেল খান ॥ ২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসেবে বিদেশী কোন ক্লাবের হয়ে খেলা প্রথম খেলোয়াড়ে পরিণত হন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের তৎকালীন সহ-অধিনায়ক এবং ফরোয়ার্ড সাবিনা খাতুন। সেই সঙ্গে গড়েন ইতিহাস। এবার সাবিনার সাফল্যের মুকুটে যোগ হয়েছে আরেকটি পালক। এবার তিনি খেলেছেন ভারতের সেথু ফুটবল ক্লাবে। সাবিনা একা নন, সেখানে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় দলের আরেক ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা রানী সরকারকেও। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শিলংয়ে শুরু হওয়া ইন্ডিয়ান উইমেন্স লীগে খেলেন জাতীয় ও অ-১৬ দলের দুই অধিনায়ক সাবিনা-কৃষ্ণা। ফিফা ফরোয়ার্ড প্রজেক্টের তত্ত্বাবধানে ৭ লাখ ইউএস ডলারের একটা প্রোগ্রাম। সেই অর্থ দিয়ে অল-ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন প্রথমবারের মতো এই লীগ আয়োজন করেছে। এই লীগে খেলেছে ৭টি দল। তারা অনেক নতুন নতুন দলকে এই লীগে নিয়েছিল। দেশের মহিলা ফুটবলকে এগিয়ে নিতে সেখানে নিজেদের সেরাটা দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন সাবিনা এবং কৃষ্ণা। কথা রেখেছেন তারা। বিশেষ করে সাবিনা। মালদ্বীপে গিয়ে তিন দফায় খেলে মোট ৫৯ গোল করেছিলেন সাতক্ষীরার মেয়ে সাবিনা। এবার তিনি ভারতে গিয়ে করেছেন ৬ গোল। যা নিজ দল সেথুর পক্ষে সর্বাধিক। ভারতীয় ক্লাবের হয়ে সাবিনা-কৃষ্ণার খেলার ডাক পাওয়াটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের নারী ফুটবল অনেক উন্নতি করছে এবং এগোচ্ছে। ওদের ওখানে খেলার ডাক পাওয়াটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের জন্য বড় প্রাপ্তি। এই ধারাটা সবে শুরু হলো। আগামীতে তাদের দেখানো পথ ধরে অন্য মেয়েরাও নিশ্চয়ই নিজেদের যোগ্যতায় ওখানে যাবে। ভারতীয় লীগ দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যেখানে ভাল পারফর্মেন্সের সুবাদে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে সে দেশের ক্লাবগুলোর। ভারতীয় লীগে সেথুর জার্সিতে দ্যুতি ছড়িয়েছেন সাবিনা। ৭ ম্যাচে যে ১১টি গোল করেছে তামিলনাড়ুর ক্লাবটি, তার ৬টিই এসেছে এই স্ট্রাইকারের পা থেকে। কৃষ্ণা-সাবিনার পারফর্মেন্সে এতটাই মুগ্ধ সেথু সভাপতি সিনি মোহাইদীন, যে আগামী মৌসুমে একই দলে তাদের খেলার আগাম প্রস্তাবও নাকি দিয়ে রেখেছেন। এর আগে মালদ্বীপের ঘরোয়া লীগে অংশ নিয়ে প্রতিপক্ষকে গোলবন্যায় ভাসিয়েছিলেন সাবিনা। এবার দ্বিতীয় বাংলাদেশী ফুটবলার হিসেবে ভিনদেশী লীগে অংশ নিয়েছেন কৃষ্ণা। এই দুই ফুটবলার মনে করছেন, ভারতের মাটিতে তাদের পারফর্মেন্সে আরও বেশি বাংলাদেশী ফুটবলারের সুযোগ মিলবে সে দেশের লীগে। এ বছরের অক্টোবরে শুরু হবে ভারতীয় নারী ফুটবল লীগের তৃতীয় আসর। কৃষ্ণা-সাবিনা ছাড়াও সেখানে দেখা যেতে পারে তহুরা, শামসুন্নাহার ও আঁখি খাতুকে। সেথু প্রথম ম্যাচেই হেরে যায়। তবে তারপর টানা ম্যাচ জিতে সেমিতে ওঠে। দলকে সেমিতে নেয়ার প্রধান কৃতিত্ব ছিল সাবিনার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেমির লড়াইয়ে হেরে যায় তাদের দল। সাবিনাদের প্রতি সেথুর খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের মনোভাব ছিল বেশ ইতিবাচক। দলের সতীর্থরাও তাদের খুব আপন করে নিয়েছিল। বলা যায় অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশেই সেখানে ছিলেন তারা। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেছেন সাবিনা। দলও ভাল খেলেছ। যে লক্ষ্য নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা পূরণ হয়েছে। তবে চেষ্টা করলে এরচেয়েও ভাল করতে পারতেন। তারপরও নিজের পারফর্মেন্স নিয়ে খুশিই সাবিনা। শুরুর দিকে দুটি ম্যাচে নিজেকে ততটা মেলে ধরতে পারেননি। কিন্তু পরে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। আসলে সাবিনাদের ওপর নির্ভর করেছে সেথু। আর সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন সাবিনারা। তবে বিদেশের লীগে খেললেও নিজের দেশে সর্বশেষ কবে লীগ খেলেছিলেন তা হয়তো মনেই নেই সাবিনার। তার মতেÑ লীগ ছাড়া তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় উঠে আসবে না। তাছাড়া বাংলাদেশে মেয়ে ফুটবলারদের জন্য খুব একটা সুযোগ-সুবিধাও নেই। যদি লীগ হয় তাহলে সেখানে অনেক মেয়ে খেলার সুযোগ পাবে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার সুযোগও থাকবে। তাই বাংলাদেশেও মেয়েদের জন্য লীগ করার সময় চলে এসেছে বলে মনে করেন সাবিনা। কৃষ্ণা রানী সরকার অবশ্য সাবিনার মতো খেলার সুযোগ পাননি। গোলও পাননি। আসলে ওদের লীগে একটা দলে ১৮ জনের স্কোয়াডে দু’জন বিদেশী থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু ম্যাচের একাদশে খেলতে পারবে মাত্র একজন। এ কারণেই সাবিনাদের খেলার সুযোগটা ছিল একটু কম। বাকিটা আসলে কোচই ঠিক করেছেন কে খেলবে, কৃষ্ণা নাকি সাবিনা। ভিসা পেতে দেরি হওয়ায় লীগ শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিন ভেন্যু মেঘালয়ের শিলংয়ে পৌঁছান সাবিনা ও কৃষ্ণা। প্রথম ম্যাচে দল হারলেও সাবিনার খেলা মন জিতে নেয় কোচের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাবিনার কারণে ইংলিশ লীগে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তানভি হ্যান্স বলতে গেলে মাঠে নামার সুযোগই পাননি। কোচ কল্পনা দাসকে সন্তুষ্ট করতে পেরে সাবিনা সন্তুষ্ট, ‘প্রথম ম্যাচে বদলি হিসেবে খেলেছিলাম। সেই ম্যাচে দল পাঁচ গোলে হারলেও আমার কিছু মুভমেন্ট কোচের ভাল লাগে। পরদিন অনুশীলনেও আমার খেলা ভাল লাগে তার। তারপর থেকে আমি প্রতিটি ম্যাচেই শুরু থেকে খেলেছি। কোচের আস্থার প্রতিদান দিয়ে গোল পেয়েছি, দলও জিতেছে।’ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তানভি হ্যান্সের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে সাবিনা বলেন, ‘আমি নিজের যোগ্যতায় দলে জায়গা করে নিয়েছি। তানভি হ্যান্সের কাছে জায়গা হারানোর কথা কখনও মনে হয়নি। আমার বিশ্বাস ছিল, পারফর্ম করতে পারলে সুযোগ পাবই।’ ২০১০ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলা সাবিনা জানান, ‘ফুটবলই আমার প্রথম প্রেম, যতদিন পারব ফুটবল খেলে যাব। আপাতত বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে চিন্তা করা যাবে।’ ক্লাবটিতে খেলার প্রস্তাব সাতক্ষীরার মেয়ে সাবিনা পান বাফুফের মাধ্যমে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘কদিন আগে থেকেই জানতাম একটা কিছু হবে। কিরণ আপার (মাহফুজা আক্তার কিরণ) সঙ্গে এটা নিয়ে পল স্যার (পল স্মলি) আগেই আলাপ করেছিলেন। পরে নিশ্চিত হয়ে আমাকে এবং কৃষ্ণাকে জানানো হয়।’ কৃষ্ণা রানী সরকার। টাঙ্গাইলের মেয়ে। ফরোয়ার্ড। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে কৃষ্ণা জানায়, ‘সুখবরটা প্রথম পাই ছোটন স্যারের (গোলাম রব্বানী ছোটন) কাছ থেকে। শুনে খুবই খুশি হই। যদিও এর পাঁচ দিন আগেই সাবিনা আপু আমাকে এ ব্যাপারে আভাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন সুখবর আসতে পারে। যদি সাবিনা আপু চান্স না পেত আর আমি একাই চান্স পেয়ে ভারতে খেলার খবরটা পেতাম তাহলে কিন্তু মোটেও খুশি হতাম না বরং মহা নার্ভাস হয়ে পড়তাম। কেননা এর আগে কখনই একা বিদেশ সফর করিনি। যখন শুনলাম সাবিনা আপুর সঙ্গেই যাব তখন খুশি হওয়ার চেয়ে বরং অনেক বেশি স্বস্তিবোধই করেছিলাম।’ বাংলাদেশের জাতীয় দল এবং সব বয়সভিত্তিক দল মিলিয়ে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফুটবলে দুটি হ্যাটট্রিকসহ মোট ২০ গোল করা কৃষ্ণা সাবিনার মতো একদিন ইউরোপের লীগে খেলতে চায়, ‘সাবিনা আপু আমার আদর্শ। এ জন্যই তার স্টাইলেই চুল কেটেছি (হাসি)! যদিও আপু মানা করেছিলেন কাটতে। আসলে বড় চুল নিয়ে খেললে ঝামেলা মনে হয়, অস্বস্তি লাগে। এ জন্যই কেটে ফেলেছি।’ ২০১১ সালে ফুটবল খেলা শুরু কৃষ্ণার। বঙ্গমাতা ফুটবলে খেলেছে জেলা পর্যায় পর্যন্ত। গোলাম রায়হান পাপন স্যার (গোলাম রব্বানী ছোটনের ছোট ভাই) এবং নিজ স্কুলের হেড স্যার আব্দুল লতিফের অবদানেই কৃষ্ণা আজ এই পর্যন্ত এসেছে।
×