প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে এসে পৌঁছেছেন। তিন-চারদিন তার অতি ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে। কমনওয়েলথ সম্মেলনে অংশ নেবেন। তারপর দেশে ফিরে যাবেন। তাকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা সংবর্ধনা দিয়েছেন। ২১ তারিখে এক নাগরিক সংবর্ধনা সভায় তিনি বক্তৃতাও দেবেন। বিএনপি যথারীতি তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। এই বিক্ষোভে প্রবাসী বাংলাদেশী কম্যুনিটির কোন অংশ নেই। বিএনপির শ’খানেক পরিচিত মুখ এবং তার সঙ্গে কিছু ভাড়া করে আনা লোক মিলে এই বিক্ষোভ দেখায়। এবার এই বিক্ষোভকারীদের সেøাগানে একটি নতুন কথা যোগ হয়েছে, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই।’
আগে শেখ হাসিনা লন্ডনে এলে এই বিক্ষোভ মিছিলের যে চরিত্র দেখা যেত, এবার তার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে এই মিছিলে একটা বন্য হিংস্রতা দেখা যেত। রাজনৈতিক সেøাগানের বদলে মিছিল থেকে অসভ্য গালি গালাজ উচ্চারিত হতো। প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনার জন্য সমবেত আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর জুতা, ইট, লাঠিসোঁটা নিক্ষেপ করা হতো। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি পর্যন্ত তা আদৌ পৌঁছতে পারত না। আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের এই বন্য হিংস্রতার মোকাবেলা করতে হতো। মাঝে মাঝে পুলিশের ধাওয়ায় এই বিক্ষোভ মিছিলের লোকেরা পালাত।
এবারও শেখ হাসিনার লন্ডন আগমনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সেই পরিচিত মুখদের মিছিল বেরিয়েছে। আগের মতোই লোক সংখ্যা, হাসিনা বা বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার মতো কিছু নয়। শেখ হাসিনার হোটেলের বহু দূরে দাঁড়িয়ে এরা উত্তেজিতভাবে হাত-পা নেড়ে সেøাগান দেয় এবং রাস্তার পথচারীরা তাদের দেখে মজা পায়। তবে এবারের বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত বন্য হিংস্রতার প্রকাশ ঘটেনি। কেবল সেøাগানের সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ বিক্ষোভের চরিত্র বদল ঘটেছে।
এর কারণ কি জানতে চেয়ে লন্ডনের বিএনপির সূত্র থেকেই জেনেছি, সম্প্রতি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে তারেক বাহিনীর আকস্মিক হামলা, ভাংচুর এবং জাতির পিতার ছবির প্রতি অসম্মান দেখানোর পর ব্রিটিশ সরকার তাদের দেশে আশ্রিত তারেক রহমানকে এমনভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যেÑ এজন্যে লন্ডনের বিএনপিকে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছে এবং সংযত হতে হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া জেলে গেছেন এবং বিদেশে পলাতক পুত্রকে দলের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। লন্ডন তাই এখন বিএনপির মূল হেড কোয়ার্টার। সুতরাং দেশে বিএনপি হাসিনাবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না, বিদেশে সেটা পারবে বলে ঢাকঢোল পিটিয়েছিল। কিন্তু লন্ডনে কেন, ইউরোপের কোন শহরেই তারা খালেদা জিয়ার কারাদ-ের পর প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে কোন আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, কোন আলোড়নই সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপির খোঁড়া রাজনীতি এখনও সুস্থতা অর্জন করেনি।
দলটির সমালোচকরা বলছেন, বিএনপির খোঁড়া রাজনীতি সুস্থ হবে কি করে, যেখানে দলের নেতৃত্ব একজন খোঁড়া লোকের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। তারেক রহমান বহুদিন ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। বাংলাদেশে এক এগারোর সরকারের আমলে জেলে থাকাকালে একদল সেনা কর্মকর্তার প্রহারে নাকি তার হাঁটুর হাড় ভেঙ্গে গেছে। এই ভাঙা হাঁটুর চিকিৎসার জন্যই নাকি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে তিনি বিদেশে এসেছিলেন। সেই যে এসেছেন আর দেশে যাননি। ইত্যবসরে তিনি নানা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলায় দেশে দশ বছরের জন্য কারাদ-াদেশ লাভ করেছেন।
প্রায় দশ বছর ধরে বিদেশে বসবাস এবং উন্নত চিকিৎসা লাভের পরও তারেক রহমানের ভাঙা হাঁটু নাকি সারেনি। তিনি এখনও বাংলাদেশের লোকজন দেখলেই খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেন। কিন্তু কোন কোন প্রত্যক্ষদর্শী ফেসবুকে খবর দিয়েছেন, তাকে নাকি নৈশ আসরে গ্লাস হাতে নাচতেও দেখা যায়। খবরটা কতটা সত্য তা জানি না।
ধরে নেয়া যাক, তারেক রহমানের ভাঙা হাঁটু এখনও সারেনি। এখানেই প্রশ্ন, খোঁড়া এবং বিদেশে পলাতক একজন নেতার নেতৃত্বে বিএনপির সুস্থ রাজনীতি চর্চা এবং সেই রাজনীতিতে সাফল্য লাভ কি সম্ভব? দলটির প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের মধ্যে এমন কেউ কি নেই যিনি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারতেন? কোন সেনাবাহিনী যুদ্ধের মাঠে অনুপস্থিত কোন আহত সেনাপতির টেলিফোনে পাওয়া নির্দেশে চালিত হয়ে যুদ্ধ জয় করতে পারে কি?
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত করেছে বিএনপির খোঁড়া রাজনীতি এবং তাদের ন্যাচারাল এলাই জামায়াতের ছুরির রাজনীতি। এই দুই রাজনীতির মিশ্রণে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু হয়েছিল, তা এখন দমিত হলেও আর্থ-সামাজিক জীবনে তার বীজ বপন করে রেখে গেছে। দেশে এখন যে গুম, খুন ও অন্যান্য অপরাধের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে সে জন্য সব দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে লাভ নেই। এর বীজ রোপিত হয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির (্্এরশাদ) আমলে। এখন সেটাই মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতারাতি এই মহীরুহের উচ্ছেদ কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। এজন্যে আওয়ামী লীগকে আমি দোষ দেই না। আমার শুধু অভিযোগ, আওয়ামী লীগ এই মহীরুহ কাটার উদ্যোগটুকুও এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেনি।
একটি সাধারণ নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমার জানা মতে, বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা যে কোন পরিস্থিতিতে এই নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, বাদ সেধেছে খোঁড়া নেতৃত্ব। তাদের আশা, দেশে না পারলেও বিদেশে প্রচারণা ও বিক্ষোভে মিছিল দ্বারা এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারা অব্যাহত রেখে তারা নির্বাচন বানচাল করতে পারবেন অথবা পেছনের দরজা দিয়ে হলেও ক্ষমতায় যেতে পারবেন। জামায়াতও আন্ডার গ্রাউন্ডে বসে ছুরি শানাচ্ছে, আবার কবে তারা বিএনপির নেতৃত্বের কাঁধে চড়ে ক্ষমতার বৃক্ষে পরগাছা হতে পারবে।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি যে বদলে গেছে এবং পুরনো খেলার পুনরাভিনয় সম্ভব নয়, এটা তারা বুঝতে পারছেন না। জামায়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সৌদি রাজতন্ত্র ওয়াহাবি প্রভাব থেকে সরে আসতে চাইছে। নারীদের স্বাধীনতা দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে, সিনেমা গৃহ তৈরির অনুমতি দিয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছে। জামায়াতিরা এখনও তাদের সমর্থন পেতে পারে, আগের মতো অর্থানুকূল্য পাবে কিনা সন্দেহ। না পেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাংলাদেশে ও অন্যান্য দেশে কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর যে দশা হয়েছে, সৌদি রাজতন্ত্রের পতনে বা পরিবর্তনে জামায়াতের সেই দশা হবে।
বিএনপির ক্যান্টনমেন্ট ও বিদেশনির্ভর রাজনীতিরও পরিবর্তন দরকার। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে যেদিন বেগম খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয় সেদিনই তার বোঝা উচিত ছিল, তার দলের পেছনে ক্যান্টনমেন্টের অখ- সমর্থন আর নেই। তারপরও গণসমর্থননির্ভর রাজনীতিতে ফিরে না এসে বিএনপি আশা করেছে, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসে ঢাকার মসনদে তাদের বসিয়ে দেবে। সেই আশার গুড়েও বালি পড়েছে। জামায়াতের ছুরির রাজনীতির সঙ্গে একাট্টা হয়ে দেশময় সন্ত্রাস চালিয়েও বিএনপি সফল হয়নি। আর এখন যদি বিএনপি আশা করে নির্বাচন বর্জন দ্বারা তারা আওয়ামী লীগকে কাবু করতে পারবে অথবা পলাতক খোঁড়া নেতৃত্বে বিদেশে প্রচারণা চালিয়ে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।
দেশের মানুষ অবশ্যই আওয়ামী লীগের বিকল্প চায়। কিন্তু তা হতে হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি। বিএনপির এই গণসমর্থনের ভিত্তি যে একেবারে নেই তা নয়, বিভিন্ন নির্বাচনে, উপনির্বাচনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিএনপিকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে এই গণসমর্থনের ভিত্তিতে ফিরে আসতে হবে। জনগণের সামনে বিকল্প গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচী তুলে ধরতে হবে। বিদেশে পালিয়ে থেকে বিদেশীদের দ্বারা চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা না করে দেশে ফেরার ও বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা মোকাবেলা করার সাহস দেখিয়ে বিএনপি নেতৃত্বকে নিজেদের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হবে। সর্বোপরি বিএনপিকে প্রমাণ করতে হবে, তারা হিংস্র মৌলবাদী রাজনীতির মিত্র নয় এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শের তারা অনুসারী, তাহলেই তাদের পক্ষে রাজনৈতিক সফাল্য অর্জন সম্ভব।
মোগল যুগে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘পার্বত্য মূষিক’। কারণ মোগল সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের সাহস তার ছিল না। তিনি পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতেন এবং গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনাও নয়, গুপ্তহত্যার পন্থা অনুসরণ করতেন। বর্তমান যুগে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তারেক রহমানের ভূমিকা মূষিকের ভূমিকা। তার গণতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বদানের যোগ্যতা এবং সাহসও নেই। তার রাজনীতি মূষিকের মতো পালিয়ে থাকা এবং সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করা। এই খোঁড়া নেতৃত্ব ও রাজনীতি দ্বারা চালিত হলে বিএনপির কোন ভবিষ্যত নেই।
লন্ডন, ১৭ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১৮