ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজীবকে শেষ বারের মতো একনজর দেখতে শত শত মানুষের ভিড়

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

রাজীবকে শেষ বারের মতো একনজর দেখতে শত শত মানুষের ভিড়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হাত হারিয়ে তেরো দিন নিদারুণ কষ্টের পর চিরবিদায় নেয়া তিতুমীর কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মঙ্গলবার হাইকোর্ট মাজারে এতিম রাজীবের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ সকাল দশটায় জানাজা শেষে নানার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে পিতা-মাতার কবরের পাশে দাফন করার কথা রয়েছে রাজীবকে। শেষবারের মতো রাজীবকে একনজর দেখার জন্য সেখানে ভিড় করেছেন শত শত মানুষ। দুই বাসের ঘষায় আহত হওয়ার পর মৃত্যু হওয়া রাজীবের পরিবারকে সরকারীভাবে সহায়তা করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। রাজীবের এতিম দুই ভাইয়ের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন আত্মীয়স্বজনরা। গত ৩ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে বাংলামোটর থেকে ফার্মগেটের দিকে যাওয়া একটি দু’তলা বিআরটিসি বাস কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশে সিগনালে থামে। একই দিক থেকে আসা স্বজন পরিবহনের একটি বাস দ্রুতগতিতে দু’তলা বাসটির পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিআরটিসি বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল রাজীব (২২)। স্বজন পরিবহনের বাসটি যাওয়ার চেষ্টা করায় দুই বাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তাতেই রাজীবের ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে দু’তলা বাসের সঙ্গে ঝুলে থাকে। রাজীবকে প্রথমে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাজীবের চিকিৎসায় সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সভাপতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ শামসুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, গত ৯ এপ্রিল দিবাগত রাত পৌনে চারটার দিকে রাজীবের অবস্থার চরম অবনতি হয়। রাতেই তাকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। ওই রাত থেকেই রাজীবের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। মাথায় মারাত্মক আঘাত লাগায় রাজীবের ফেরার সম্ভাবনা ছিল না। তারপরেও অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রায় এক সপ্তাহের মাথায় সোমবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে রাজীবের মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডাঃ প্রদ্বীপ বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রাজীবের মৃত্যু হয়েছে। রাজীবের ডান হাত বাসের ঘষায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দুই বাসের চাপে মস্তিষ্কের হাড় ভেঙ্গে গেছে। মাথার হাড়ের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। রাজীবের খালা জাহানারা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশবাহী একটি ফ্রিজিং ভ্যানে করে রাজীবের লাশ পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বুধবার সকাল নয়টায় সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানাধীন দাশপাড়ার বাঁশবাড়ির গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে রাজীবকে দাফন করা হবে। এর আগে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে। তিতুমীর কলেজ ও মতিঝিল পোস্টাল স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুইটিতে রাজীবের জানাজা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত পটুয়াখালীর বাউফল এলাকার উর্ধতন কর্মকর্তাদের উদ্যোগে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ ছাড়াও রাজীবের অনেক শিক্ষক অংশ নিয়েছিলেন। রাজীবদের কোন সহায়সম্পত্তি নেই। এজন্য ওর পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পর তাদেরও লাশ রাজীবের নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে হয়েছে। রাজীবের লাশও তার নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে পিতামাতার কবরের পাশে দাফন করা হবে। তিনি আরও জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ কে এম নাসির উদ্দিন ছাড়াও চিকিৎসকরা তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। রাজীবের লাশ বহন থেকে শুরু করে তারা অনেক সহযোগিতা করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে রাজীবের মৃত্যুর পর কথা বলেছেন। হাসপাতালের পরিচালক রাজীবের লাশ দাফন শেষে ঢাকায় এসে সরকারী সহায়তার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। ঘটনার পর পরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম হাসপাতালে রাজীবকে দেখে তার যাবতীয় চিকিৎসা খরচ বহন এবং রাজীবকে সরকারী চাকরি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর রাজীব হোসেনের চিকিৎসা ব্যয় ওই দুই বাস মালিককে বহন করার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক কোটি টাকা এবং রাজীবের কৃত্রিম হাত লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানান রাজীবের খালা জাহানারা বেগম। রাজীবের খালা আরও জানান, রাজীবের পিতার নাম হেলাল উদ্দিন (মৃত)। অপসোনিন ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। অন্তত ৯ বছর আগে মারা যান। এর বছর পাঁচেক পরেই রাজিবের মা নাসিমা বেগম মারা যান। রাজীব মতিঝিলে তার বাসায় থেকে পোস্টাল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। আর পুরনো ঢাকায় অবস্থিত সরকারী শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এরপর তিতুমীর সরকারী কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে পড়ছিল। রাজীব টিউশনি করে এবং একটি কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করে ছোট দুইটি ভাইয়ের খরচ যোগাত। দুই ভাই যাত্রাবাড়ী তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় (এতিমখানা) পড়ছে। মেহেদী হাসান সপ্তম শ্রেণীতে আর হৃদয় হাসান আব্দুল্লাহ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। রাজীবের দুইটি ভাইয়ের জন্য সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন হৃদয়বান ব্যক্তি যদি বাসস্থানের ব্যবস্থা করে তাহলে দুইটি ভাই চিরদিনের জন্য নিশ্চিন্ত হতে পারবে। বাউফল থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা কামরুজ্জামান বাচ্চু জানান, রাজীবের নানা লাল মিয়ার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে পিতামাতার পাশে রাজীবকে দাফন করা হচ্ছে। বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। রাজীবের মৃত্যু জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ ও বাউফলের এমপি আসম ফিরোজ, পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাউফল পৌরসভার মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল, উপজেলা চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মোশারেফ হোসেন খান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মোতালেব হাওলাদার, সাংগঠনিক সম্পাদক ইব্রাহিম ফারুক গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, গত সোমবার রাজীবের সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রধরে দায়েরকৃত মামলার দুই আসামি বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন পরিবহনের বাসের চালক খোরশেদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এর আগে আদালত বিআরটিসি বাসটি হেফাজতে দুইটি বাসের মালিকানা যাচাইবাছাই করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আফতাব আলীকে নির্দেশ দেয়।
×