ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জেরায় জেরবার জাকারবার্গ, উদ্বিগ্ন নেটিজেন

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

জেরায় জেরবার জাকারবার্গ, উদ্বিগ্ন নেটিজেন

জিনস আর ছাই রঙা টি-শার্টে ‘কুল এ্যান্ড ক্যাজুয়াল’ ইমেজ নিয়ে আমাদের পরিচিত পৃথিবী তিনি বদলে দিয়েছেন অনেকটাই। একবিংশ শতাব্দীতে এই গ্রহের বাসিন্দাদের জীবন তার মতো করে আর কে বা প্রভাবিত করেছে? সাফল্যের চূড়োয় বসে ভাসছিলেন প্রশংসার বন্যায়। জীবন উপভোগ করছিলেন বিন্দাস। এরপর সেই গান, ‘এক ঝড় এসে ভেঙ্গে দিয়ে গেল... তাই জীবনটা এলোমেলো।’ ঝড়ের নাম ক্যামব্রিজ এ্যানালাইটিকা। পরিণতি? জিনস-টি-শার্ট ছেড়ে এক ধাক্কায় কোট-টাই এক্সিকিউটিভ। স্বপ্নঘুম ভেঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করলেন কংগ্রেসের শুনানিতে। একের পর এক ধেয়ে আসা প্রশ্নে বিব্রত, গলদঘর্ম। দোষ স্বীকার করে চিঠি পাঠিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন আগেই। যাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে, তাদের সঙ্গে দেখা করে ম্যানেজেরও চেষ্টা করেছেন। ভবি ভোলেনি। উল্টো কমিটির কাছে হাজির হওয়ার আগেই তদন্তকারীদের সঙ্গে দেখা করায় প্রশ্ন উঠেছে তার উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রশ্নের মুখে বেরিয়ে এসেছে এমন কিছু সত্য যা বাড়িয়ে দিয়েছে নেটিজেনদের উদ্বেগ। জানাচ্ছেনÑ আকিল জামান ইনু ক্যামব্রিজ এ্যানালাইটিকা কা-ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেল থেকে ক্যাপিটল হিলে শুরু হওয়ার কথা ছিল শুনানি। প্রথমে সিনেটের বাণিজ্য ও বিচারবিভাগীয় কমিটি, পর দিন মার্কিন কংগ্রেসের শক্তি ও বাণিজ্য কমিটিতে হাজির হওয়ার কথা তার। শুনানির আগেই দ্বিতীয় কমিটি প্রকাশ করে দিয়েছে তাদের কাছে পাঠানো জাকারবার্গের আগাম চিঠির বিবরণ। যে চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘সমাজের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা, তাকে খাটো করে দেখাটাই ভুল হয়েছে। সব দোষ আমার। আমি দুঃখিত।’ ব্যাস। আবারও উঠেছে প্রশ্নের ঝড়। তদন্তের আগেই সিনেট কমিটির নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরে ক্ষমা চাওয়াটা কতটা নৈতিক? এটা কি তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা? কেন এই অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা? কী লুকাতে চাইছেন তিনি, সে প্রশ্নও উঠেছে। যদিও ফেসবুক বলেছে, এটা নিছক সৌজন্য সাক্ষাত। জাকারবার্গ বলছেন না কিছুই। বিষয়টি তদন্ত শুরুর আগেই তার নিষ্কলুষ ভাবমূর্তিতে লেপে দিয়েছে এক পোঁচ কালি। বোঝা যাচ্ছিল ঘটনা গড়াবে আরও এবং তাই হয়েছে। তদন্ত শুরুর আগে তদন্তের মোড় ঘোরানোর চেষ্টাকে সিনেটররাও ভালভাবে দেখেননি। ক্ষমা চাইতে সোমবার প্রথম গিয়েছিলেন বিল নেলসনের কাছে। উত্তর ফ্লোরিডার ডেমোক্র্যাট সদস্য বিল সিনেটের বাণিজ্য বিষয়ক কমিটির নেতা। তার বক্তব্য, ‘চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখছেন না জাকারবার্গ। কিন্তু আমি সন্দিহান। অন্তত এ বার তাকে চেপে না-ধরলে নেটিজেনদের ব্যক্তি পরিসর বলে কিছুই থাকবে না।’ সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, জাকারবার্গ সোমবার রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাট মিলিয়ে অন্তত চার জন সিনেটরের সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে নেলসন ছাড়া আর কেউ সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। ফেসবুকের দাবি, তথ্য সুরক্ষায় ও ভোটের হাতিয়ার না হওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করছে। নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন, নানাবিধ জনপ্রিয় পেজের ওপর। এমনকি, ভোটে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তারা নিজেরাই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন বসাতে চায়। বরাবরের মতো এবারও জাকারবার্গের আশ্বাস, ‘নিজেদের লাভের খাতা মোটা করার চাইতে নেটিজেনদের তথ্য নিরাপদ রাখাটাই আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। ফেসবুক থেকে তথ্য চুরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যে কারণে ২০০৬ থেকে ২০১১-এর মধ্যে বছরে অন্তত একবার করে ক্ষমা চেয়েছেন জাকারবার্গ। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসও বেশ কয়েক বার তলব করেছিল তাকে। নানা ভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এবারের এ্যানালাইটিকা-কাে মুখ পোড়াার পর, রেহাই পেলেন না যেতেই হলো, নিষেধাজ্ঞার খড়গ মাথায় নিয়ে। নিষেধাজ্ঞা রুখতেই বেছে নিয়েছেন ক্ষমাভিক্ষার পথ। দু’-এক সপ্তাহ বা মাস নয়, নিজেদের শোধরাতে সময় চেয়েছেন কয়েক বছর! চিঠিতে জাকারবার্গ লিখেছিলেন, মার্কিন নির্বাচনে রুশ প্রভাবের কথা বুঝতে দেরি হয়ে গিয়েছিল তাদের। এ্যানালাইটিকা-কা আর হবে না। ভুয়া খবরের রমরমা, উস্কানিমূলক মন্তব্যে পরোক্ষে হিংসা ছড়ানো নিয়েও ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার টানা পাঁচ ঘণ্টা জেরায় জেরবার জাকারবার্গ বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো মুখোমুখি হন হাউজে শক্তি ও বাণিজ্য কমিটির। আগের দিন জাকারবার্গের এড়িয়ে যাবার চেষ্টাকে এদিন তারা ছাড় দেননি মোটেও। সদস্যরা প্রশ্ন করেছেন চড়া সুরে। চাপ দিয়েছেন হ্যাঁ অথবা না জবাবের জন্য। জ্যাকারবার্গের মুখে, ‘জবাব দিতে পারছি না!’ শুনে করেছেন উপহাস। প্রশ্ন বিস্তৃত হয়েছে নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, ডাটা বিনিময়, ফেসবুকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কার্যক্রম। এমনকি এ প্রশ্নও উঠেছে। ফেসবুক কি পরোক্ষভাবে হলেও ড্রাগ বিক্রি অনুমোদন দিচ্ছে কিনা। জাকারবার্গকে প্রথমেই মুখোমুখি হতে হয় ২০১৬তে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাম্পেইনে জড়িত ক্যামব্রিজ এনালাইটিকার ব্যবহার করা ডাটা নিয়ে যা ফেসবুক থেকে নেয়া হয়েছে। জাকারবার্গ বারংবার ক্ষমা চেয়ে বলেছেন যে, ঘটনাটিতে শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি তিনি জানতে পারেন গার্ডিয়ার্সে প্রকাশিত রিপোর্ট পড়ে। এরপর শুনানি এগিয়েছে এভাবে। মাইক ডোয়েল : আপনি কি শর্ত ভঙ্গ করে তথ্য পাচারের বিষয়গুলো কেবল প্রেসের কাছ থেকেই জানতে পারেন? জাকারবার্গ : অনেক সময়ই বিষয়টা এমন। তিনি এও জানান তার ব্যক্তিগত তথ্যের বেলাতেও এমনটা ঘটেছে। গ্রেগ ওয়ালডেন : ফেসবুক কি মিডিয়া কোম্পানি? এটি কি কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান? জাকারবার্গ : আমি মনে করি, আমরা একটি টেকনোলজি কোম্পানি। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা কোডিং করেন। মানুষের জন্য পণ্য ও সেবা প্রদান করেন। এর বাইরেও আমরা কিছু কাজ করি। আমরা মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপনের বিষয় নিয়েও কাজ করি। এটাও ঠিক আমি মনে করি না আমরা কোন এ্যারোস্পেস কোম্পানি। ববি রাশ : অনাধিকার প্রবেশ এবং ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে কি বলবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি টেনে আনেন প্রাক্তন এফবিআইর প্রাক্তন সুপ্রিমো জে এডগার হুভার এর কথা এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য জানতে চান। জাকারবার্গ : পার্থক্যটা পরিষ্কার। ফেসবুকে দেয়া তথ্যের উপর ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যে তথ্যগুলো আমরা সংগ্রহ করি সে বিষয়ে ব্যবহারকারী চাইলে না করতে পারেন; বড় কথা হলো আপনি চাইলে ফেসবুক ছেড়ে যেতে পারেন। ওয়ালডেন : আপনার কি মনে হয়নি ডাটা সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যবহারকারীদের কাছে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে উপস্থাপন করা উচিত। জাকারবার্গ : আমি বলব, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবহারকারীদের তা জানাতে চেষ্টা করি। আমার ধারণা ব্যবহারকারীরা জানেন তারা কাদের সঙ্গে পোস্ট শেয়ার করতে চান। মাইকেল বার্গেস : বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখি, আপনার কি মনে হয় সাধারণ মানুষ কি শর্তগুলো ভালভাবে দেখে, এই শর্তগুলোতে সম্মতি দেয়া কি আমার জন্য নিরাপদ? জাকারবার্গ : কেউ যদি জানতে চায় তবে তারা সেটি পারে। কিন্তু বেশিরভাগ লোকেই বিষয়টি না দেখেই সম্মতি প্রদান করেন। আমি বিষয়টি কেবল আইনগতভাবে দেখি না আমি চাই তারা বুঝুক বিষয়টি। তিনি দাবি করেণ ব্যবহারকারীরা ডাটার ব্যবহার ভালভাবেই বোঝেন। ডানিয়া ডি গ্যাটে : প্রশ্ন তোলেন ফেসবুকের বিলিয়ন ডলার লাভের বিপরীতে নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়াতে অর্থদ-ের বিষয়ে। তিনি লেনে বনাম ফেসবুক, ফ্রেলেই বনাম ফেসবুক মামলা দুটোর প্রসঙ্গ সামনে আনেন। জাকারবার্গ : আমি মামলাগুলোর বিষয়ে সেভাবে অবহিত নই। তার এই উত্তরে কমিটির সদস্যরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। এমনকি জাকারবার্গ যখন ২০১১তে এফটিসি পরিচালিত তদন্তের বিষয়ে বলেন, তিনি তা মনে করতে পারছেন না। ডানিয়ার ভাষায় সেটি ছিল এড়াতে চাওয়া। জি কে বাটারফিল্ড : ফেসবুকের ওয়েবসাইটে নেতৃত্ব দেয়া ৫ জনের কেউ কালো নয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি মার্কিন জাতির দর্শনকে প্রতিফলিত করে না। জাকারবার্গ : এই পাঁচজনের বাইরেও আমাদের নেতৃত্বে অনেক লোক আছেন। জাকারবার্গ আরও বলেন, ‘কংগ্রেসম্যান, বিষয়টি নিয়ে আমরা আপনাদের সঙ্গে কাজ করব।’ অবশ্যই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডেভিড ম্যাককিনলে : ফেসবুকে ড্রাগসের বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আরও বলেন, বিষয়টি আইনবিরোধী। তিনি জাকারবার্গকে তার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন যে, তিনি কথা দিয়েছিলেন এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহারের। জানতে চান তিনি কবে তা করবেন। জাকারবার্গ : এমন অনেকগুলো বিষয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে। লুজান : ফেসবুকে কখনই যোগ দেননি এমন মানুষের তথ্যও আপনারা সংগ্রহ করছেন। হ্যাঁ অথবা না। জাকারবার্গ : সাধারণত আমরা নিরাপত্তার খাতিরে তাদের তথ্য সংগ্রহ করি। কেনেডি : ব্যবহারকারীদের অজ্ঞাতেও অনেক তথ্য আপনারা সংগ্রহ করছেন এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। জাকারবার্গ : হ্যাঁ। সদস্যরা এরপর প্রশ্ন তোলেন সিভিল রাইট নিয়ে। যথারীতি আগের দিনের মতো জেরবার জাকারবার্গ। ফেসবুক আজ এই গ্রহের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবনের অংশ। তাই এর কোন রকম অপব্যবহারে ব্যবহারকারীরা উদ্বিগ্ন হবেন সেটাই স্বাভাবিক। আপাতত এটা বলা যায় জাকারবার্গের উত্তর সেই উদ্বেগ নিরসন না করে আরও বাড়িয়েছে। [email protected]
×