ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের পণ্য ও সেবা উভয় ক্ষেত্রেই বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। তাই সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতিতে একের পর এক রেকর্ড করছে দেশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। মূলত আমদানি ব্যয় বাড়ছে লাগামহীনভাবে। সে অনুযায়ী বাড়ছে না রফতানি আয়। ফলে লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে; ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি এক হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার দাঁড়ায়। যা দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি। একমাস পর ফেব্রুয়ারিতে এ ঘাটতি আরও বাড়ল। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আট মাস শেষে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬০৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৫৬৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৯২ শতাংশের ওপরে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, প্রতি ডলার ৮৩ টাকা হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ৪৬ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যতটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। এসব বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি বেড়ে গেছে। এছাড়াও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। এসব কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। তবে এই ঘাটতি মেটানো হয় রেমিটেন্স ও বিদেশী বিনিয়োগ দিয়ে। এই খাতেও নিম্নগতি রয়েছে। ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ভাল নয় বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের আমদানি যে হারে হয়েছে সেই হারে রফতানির প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। এ কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। এদিকে রেমিটেন্স প্রবাহও এখন কম। সব মিলিয়ে চলতি হিসাব ঋণাত্বক হয়ে পড়েছে। এ লেনদেনে ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদী হলে তা অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, দেশে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে এটা মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য হলে ভাল। তবে সে হারে দেশে বিনিয়োগ বাড়েনি। তাই আমদানির নামে অর্থপাচার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে দুই হাজার ৪০৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৫৮২ কোটি ডলার। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় এক হাজার ১৭৩ কোটি ২০ ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, প্রতি ডলার ৮৩ টাকা হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচিত সময়ে, আমদানি বেড়েছে ২৬ দশমিক ২২ শতাংশ হারে। অন্যদিকে রফতানি বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোন ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভাল। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্ত থাকলেও গেল অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। জানুয়ারি শেষেও এ ধারা অব্যাহত রযেছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর জুড়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। এতে বৈদেশিক দায় পরিশোধে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১৪৮ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৬৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। আলোচিত সময়ে সেবা খাতে বিদেশীদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়েছে ৫৭৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে মাত্র ২৮০ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ হিসেবে আট মাসে সেবায় বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারে। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল (ঘাটতি) ২১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। দেশে বিদেশী বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে মোট ১২৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২৫ কোটি ডলার। আলোচিত সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ৩১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
×