ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

ঢাকার দিনরাত

ঢাকায় রাস্তা নাকি ঝাড়ু দেওয়ার রেকর্ড হয়েছে। এক সঙ্গে ১৫ হাজার ৩১৩ জন লোক মিলে ঢাকার রাস্তায় এক মিনিট ঝাড়ু দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে ঢাকাবাসী। ‘মন সুন্দর যার, সে রাখে দেশ পরিষ্কার’-এমন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শুক্রবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এর উদ্যোগে প্রতীকী পরিচ্ছন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে ঢাকার রাস্তায় ঝাড়ু দেন নগরবাসী। এক সঙ্গে এত মানুষের অংশগ্রহণে পরিচ্ছন্ন এ কর্মসূচীর মাধ্যমে গিনেস বুকে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো তখনই বুঝি সার্থক হবে যখন সত্যি সত্যি নগরবাসী পরিচ্ছন্ন রাখবে পরিবেশ, আর পৌর কর্তৃপক্ষও দায়িত্বশীলতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে প্রতিদিন। সে যাক, নববর্ষ বরণ উৎসব নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। তাই বিশদ বলার কিছু নেই। শুধু কয়েকটি বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। বর্ষবরণ প্রতি বছরই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। বিধিনিষেধের মধ্যে উৎসব কিছুটা ছাঁটা পড়লেও তাতে প্রাণের রঙটুকু বরাবরই উজ্জ্বল। এবার সারাদিনই ছিল রোদঝলমলে পরিবেশ, যথেষ্ট গরমও বটে। যদিও বিকেল বেলায় ঢাকার আকাশে মেঘ জমতে শুরু হয়। সন্ধ্যায় রীতিমতো ঝড়-বাদলে ঢাকা পড়ে রাজধানী। শিলাবৃষ্টিও হয়েছে। তবু ঘরে ঘরে যেসব বৈশাখী আয়োজন পূর্বনির্ধারিত ছিল সেগুলোও শেষ পর্যন্ত কিছুটা বিরতি দিয়ে আয়োজন শুরু করে। উৎসবের রঙ ও নকশা বৈশাখের দ্বিতীয় দিবসে হয়তো মনেই হবে না যে আগের দিন এমন বাঁধভাঙা আনন্দ করেছে ঢাকাবাসী। তবে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে কেউ গেলে তিনি উৎসবের রেশটুকু ঠিকই পাবেন। এই প্রশস্ত সড়ক ৩৫০ চিত্রশিল্পীর তুলির ছোঁয়া পেয়েছিল। সড়কের মধ্যভাগে ও দুই পাশে সবুজের সমারোহ; এমাথা-ওমাথা জুড়ে রঙিন আলপনার জাগরণ। সত্যিই দৃষ্টিনন্দন সৃজন। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আল্পনার রঙে রাঙানো হয়েছিল মানিক মিয়া এভিনিউকে। বিগত কয়েক বছরের মতো এবারো সাজানো হয়েছে প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে রাত থেকেই এই আয়োজন দেখতে সংসদ ভবন এলাকায় ভিড় জমান নগরবাসী। ১৬টি দলে বিভক্ত হয়ে চিত্রশিল্পীরা সাজিয়েছেন প্রিয় এই নগরীকে। সবার চোখেমুখেই ছিল নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার উচ্ছ্বাস। গত পাঁচ বছরের মতো এবারের আয়োজন দেখতে রাত থেকেই মানিক মিয়া এভিনিউতে ছিল ভিড়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নিয়ে এমন উপস্থিতি জানান দেয় নতুন বছরের উৎসবের আগমনী বার্তা। আলপনা আঁকার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। ঢাকার তাপমাত্র বেড়েই চলেছে। ঢাকায় যে প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপ অনুভূত হচ্ছে তার কিছু কারণ রয়েছে। ঢাকা প্রায় বৃক্ষশূন্য, কয়েকটি উদ্যানেই কিছুটা গাছের সমাহার লক্ষণীয়। আর হাজারে হাজার গাড়ি এবং লাখো ফ্ল্যাটের এসি থেকে নির্গত গরম বাতাস রাজধানীকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। শহরের ভেতর বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডও দায়ী এই অসহনীয় তাপ বাড়ানোর জন্য। সব অন্তরসম্পদ থেকে সম্পন্ন হওয়া রমনার বটমূলে বর্ষবরণের আয়োজনে ড. সনজীদা খাতুন অত্যন্ত সময়োপোযোগী ও তাৎপর্যময় ভাষণ দিয়েছেন। প্রভাতী আয়োজনে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেন, ‘শিকড়ের মাটিতে দৃঢ়বদ্ধ থেকে বিশ্বায়নের ফলে পাওয়া সত্য-সুন্দরকে আত্মগত করে ঋদ্ধ হব আমরা। যে মাটি আমাদের পায়ের তলায় আশ্রয়, জন্মের শুভক্ষণে সেই মাটিতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছি আমরা। জন্মসূত্রে এ মাটি আমাদের একান্ত আপন। সে মাটির বুকে শিকড়ের মতো পা ডুবিয়ে মাটি-মাতাকে জানব আমরা। এমন স্বভাবসম্মত প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠে আত্মপরিচয়ে প্রত্যয়ী, আর প্রতিষ্ঠিত হব আমরা বাংলাভূমির সর্বজন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বায়ন আজ আমাদের কাছে বাস্তব সত্য। এ শব্দ নিন্দা অর্থে উচ্চারণ করছি না। বিশ্বের সঙ্গীতে-সাহিত্যে, শিল্পকলায়-দর্শনে-বিজ্ঞানে যে মহান অর্জন তার স্বাদ নেব আমরা। আত্মস্থ করতে হবে সকল মানবিক অন্তরসম্পদ। সেই সত্য সুন্দর সমৃদ্ধ করবে আমাদের।’ সার্বিক কল্যাণের বোধে পূর্ণ প্রীতিতে ‘সর্ব মানবের অভিমুখে’ সংস্কৃতিকর্মীদের যাত্রা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান ৮৫ পেরুনো এই শিল্পী, সংগঠক। জাতীয় বিবেচনায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব আমাদের অনুধাবন করতে হবে। গত বছর ছায়ানট কর্ণধারের বক্তব্য স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন- ‘সংস্কৃতি’ অস্ত্র দিয়ে নতুন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এসেছে। সংস্কৃতিচর্চা যারা করেন তাদের বিশেষ দায় রয়েছে। আমরাও বার বার সাংস্কৃতিক আয়োজন জোরদার করার কথা বলে থাকি। এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে মৌলবাদীরা হুঙ্কার দিয়েছে। ফলে প্রশাসন থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরী হয়ে ওঠে। তাই বলে মঙ্গল শোভাযাত্রার সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ থাকবে- এটা ভাবিনি। এটি শোভাযাত্রার শোভাই অনেকখানি নষ্ট করেছে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গত বছর ঐতিহ্য হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতির পর শোভাযাত্রার আয়োজনটি আরও বর্ণাঢ্য, উৎসবমুখর ও ঢাকায় বসবাসকারী বিদেশীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হোক- এমনটাই ছিল চাওয়া। তা হয়নি। বৈশাখ আসার আগে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে বৈশাখকে আহ্বানই যৌক্তিক মনে হয়। বৈশাখের জন্য প্রস্তুতি, বর্ষ শেষের চৈত্রসংক্রান্তি আর বসন্তযাপন- এই সব মিলিয়ে নিকট বন্ধুজনদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গুরুত্বই অন্যরকম। হাতি দিয়ে ঠেক! ধানমন্ডি থেকে একজন ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করলেন। তাতে দেখা গেল একটি হাতি রাস্তার ওপরে দাঁড়ানো ও চলমান গাড়িগুলোর কাছে যাচ্ছে এবং শুঁড় দিয়ে কী যেন তুলে নিয়ে তার পিঠে চেপে বসা লোকটিকে দিচ্ছে। পুরনো ঢাকাতেও এমন অভিজ্ঞতার কথা আগেই শুনেছিলাম। খুলেই বলি। সেদিন উত্তরার আবাসিক এলাকায় এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। হাতি চাঁদাবাজিতে নেমেছে! রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী প্রাইভেট কারের সামনে দাঁড়িয়ে গর্জন করে শুঁড় বাড়িয়ে দিচ্ছে চালকের জানালা বরাবর। এমনই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে অযতেœ পালিত কর্কশ-দর্শন ঐরাবতকে। আর তাকে পরিচালনা করছে হাতির পিঠে চেপে বসা এক লোক। মানুষ বিরক্ত হচ্ছে, আবার ভয়ও পাচ্ছে। হাতির ধাক্কায় গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসব দেখার কি কেউ নেই! অথচ উত্তরার প্রতিটি সেক্টরে কল্যাণ সমিতি রয়েছে। তাদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আছে। আসলে এরা স্বেচ্ছাশ্রম দেন না। এলাকাসীর কাছ থেকে বাধ্যতামূলক অনুদান/ চাঁদা গ্রহণ করেন। তা না হয় করুন, কিন্তু এলাকাবাসীর নিরাপত্তা তো দিতে হবে! একইভাবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই আপদ থেকে মানুষ কীভাবে রক্ষা পাবে? বসন্তের ফুল এই বৈশাখে বসন্ত বিদায় নিলেও বসন্তের ফুল তো আর রাতারাতি সুবাস বিলানো বন্ধ করে না! বরং এই বৈশাখে ঢাকায় চোখ মেলে তাকালে দেখা পাওয়া যাবে বাসন্তী সুন্দরের। নাগলিঙ্গম ফুলের কথা মনে করিয়ে দিলেন এক সতীর্থ কবি। বড় মাতোয়ারা করে এর মিষ্টি সুরভী। আর এর গোলাপি রংটা কত-না মনকাড়া! গঠনটাও আকর্ষণীয়। বেশ বড় ফুলটা। এর পুংকেশর স্তবক খুব দর্শনীয় রকম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কিছু গাছ আছে যাদের ফুল-ফল ধরে কাণ্ডজুড়ে। এটি তেমন একটা গাছ। এর ফলও দেখবার মতো বিশাল। নারিকেল ছিললে যেমন দেখায়, তেমন। ইংরেজিতে তাই বুঝি এর একটা প্রচলিত নাম ঈধহড়হনধষষ ঃৎবব. হুম, কামানের গোলার মতই বটে। হাতির প্রিয় খাদ্য। তাই একে হাতির জোলাপও বলে। গাছটি দুর্লভ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন উদ্যানে সংরক্ষণ করায় এখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গাছটি আছে : রমনা পার্ক, কার্জন হল, মহানগর উদ্যান (গুলিস্তান), চারুকলা অনুষদ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান...। তরুণ কবি মোহসেনা ইলোরা ‘সোনালু’ ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন: আমাকে, একগোছা সোনালু এনে দেবে? আমি খোঁপায় জড়াবো। আমার মনের গভীরে মিশে থাকা সোনালীর সঙ্গে, একটু, মিলিয়ে দেখবো। সোনালুটা আমার দারুণ পছন্দ! কী সুন্দর! কী সুন্দর! ঝর্ণার মতো, বৃষ্টির মতো, রিনিঝিনি কাঁচের চুড়ির মতো, শুধু হলুদ নয়, যেনো আলোর মশাল জ্বেলে, বিনিসুতোয় অবিরাম সুখ ঝড়ে পড়ে, মনের জানালা গলে।... রাতে অরক্ষিত ফ্লাইওভার ঢাকার কোনো কোনো ফ্লাইওভার রাতের বেলা অনেকটাই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটি দিয়ে চলা এখন অনেকটাই অনিরাপদ। প্রায়শ এখানে ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। কাগজে পড়লাম সম্প্রতি এই ফ্লাইওভারে একটি চলন্ত সিএনজি অটোরিকশার চালক দুজন শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্রের মুখে প্রাইভেট কার ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে এখানে। ঘটেছে মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের ঘটনাও। রাতে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাস প্রভৃতি যানবাহনের যাত্রীরা প্রায় সময় বিপদে পড়ছেন। ইদানীং কুড়িল ও খিলগাঁও ফ্লাইওভারেও রাতে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেড়েছে। গাড়ি থামাতে ব্যর্থ হলে অপরাধীরা পিছন থেকে ককটেল ছুড়ে মারছে। এছাড়াও এসব ফ্লাইওভারের নিচে মাদকাসক্ত ও ছিনতাইকারীদের আড্ডাও চলে থাকে। মহাখালী, খিলগাঁও, বনানী, তেজগাঁও, কুড়িল ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার ফুটওভারব্রিজগুলোর মতো অরক্ষিত ও অনিরাপদ থাকতে পারে না। ফ্লাইওভারের কাছাকাছি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের এ ব্যাপারে তৎপর হওয়া দরকার। তাছাড়া ফ্লাইওভারের ওপরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এমনটা আশা করা যায়। ১৫ এপ্রিল ২০১৮ [email protected]
×