ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

প্রাথমিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

দেশে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছু কম হচ্ছে না। এবারে প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) পরীক্ষা ২০১৮-এর নতুন প্রশ্ন কাঠামো ও নম্বর বিভাজন চূড়ান্ত করে প্রকাশ করেছে ওয়েবসাইটে। এতে এমসিকিউয়ের পরিবর্তে ছোট-বড় প্রশ্ন রাখা হয়েছে, যেগুলোর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে হবে লিখিত আকারে। শতভাগ লিখিত প্রশ্নের আকারে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে প্রথম সাময়িক থেকেই। অর্থাৎ প্রশ্নের ধরন অনুযায়ী পুনরায় ফিরে যাওয়া হলো পূর্বাবস্থায়। গত কয়েক বছর ধরে দেশব্যাপী বহুল আলোচিত ও নিন্দিত প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতেই এমসিকিউ বাদ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নতুন প্রশ্ন কাঠামো। তবে এই পদ্ধতিতে যে প্রশ্ন ফাঁস হবে না, এই গ্যারান্টি দেবে কে বা কারা। তদুপরি শিক্ষার মান যে বাড়বে সেই নিশ্চয়তাই বা কোথায়? প্রাথমিক শিক্ষায় গত বছর ফল বিপর্যয় ঘটেছে। প্রশ্ন ফাঁসের খবরও আছে। এর আগে প্রতি বছরই পাসের হারের ক্ষেত্রে মাইলফলক অতিক্রম করেছিল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা। গত বছর ঘটেছে ব্যতিক্রম। পাসের হার ও জিপিএ-৫সহ প্রায় সব সূচকেই গতবার খারাপ ফল করেছে শিক্ষার্থীরা। অষ্টম শ্রেণীর জেএসসিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে কমেছে ১০ শতাংশ। আর পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে পাসের হার কমেছে ৩ শতাংশ। অবনতি ঘটেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও। মোট কথা, শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে ফেলের সংখ্যা। অতীতের মতো বলা হয়েছে, ইংরেজী ও গণিতে খারাপ করায় ঘটেছে ফল বিপর্যয়। উল্লেখ্য, এ দুটো বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরও অভাব আছে সারাদেশে। প্রধানমন্ত্রী ফল হাতে পেয়ে সারাদেশে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য নিবিড় তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি। নতুন শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাস্তবায়িত করার সরকারী ঘোষণা থাকলেও সর্বশেষ অবস্থা হয়েছে লেজেগোবরে। শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করা নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একদিকে পরীক্ষামূলকভাবে ৬২৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বছরখানেক আগে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৌখিকভাবে ন্যস্ত করলেও প্রশাসনিক জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কায় তা হস্তান্তর করতে পারছে না। ফলে তা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ে। সর্বোপরি অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নেই। শিক্ষক স্বল্পতাও সুবিদিত। রাতারাতি এসব গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। বাজেট ঘাটতির বিষয়টিও আছে। মোটকথা, প্রাথমিক শিক্ষা সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়। ফলে স্বভাবতই প্রবল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে সারাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কবে নাগাদ তা বাস্তবায়ন হবে অথবা আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা, তাও বলতে পারছে না কেউ। ফল বিপর্যয়ে এটিও প্রভাব ফেলতে পারে বৈকি। এবার আসছে নতুন কাঠামোর প্রশ্নপত্র। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হলে সময় প্রয়োজন। কেননা, এর জন্য লাগবে অর্থ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উপযুক্ত শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ, তাদের মর্যাদা সর্বোপরি যথাযথ পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। তাহলে এত আগে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ঘোষণা করার দরকার কী ছিল? লাখ লাখ মাসুম শিশু ও অভিভাবকদের কি নাকানি-চুবানি না খাওয়ালে চলত না? সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এটা বুঝতে হবে যে, প্রাথমিক শিক্ষা ও বইপুস্তক অবৈতনিক হলেও সমাপনী পরীক্ষার নামে শিশুদের কোচিং ও সৃজনশীল প্রশ্নের নামে গাইড বইয়ের জন্য গুচ্ছের খরচ হয়ে থাকে অভিভাবকদের। এর ওপর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ কেন্দ্র পরিবর্তনের দুশ্চিন্তা ও দৌড়ঝাঁপ তো আছেই। এই অসহায়ত্ব থেকে শিশু ও অভিভাবকদের মুক্তি দিতে হবে অনতিবিলম্বে। শিশুদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নয়।
×