ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দশটি করে আবাসন সংরক্ষণ;###;সরকারী এ ব্যবস্থা অনেকেরই অজানা

দেশের প্রতিটি শিশু পরিবারে খোলা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

দেশের প্রতিটি শিশু পরিবারে খোলা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম

সমুদ্র হক ॥ বিষয়টি অনেকেই জানে না। দেশের প্রতিটি শিশু পরিবারে সরকারীভাবে বৃদ্ধাশ্রম খোলা হয়েছে। যেখানে পরিবারের অবহেলিত বয়স্ক ব্যক্তিগণ নিজের বাড়ির মতো শিশুদের সঙ্গে থাকবেন। শিশুদের মনে করবেন তারাই নাতি-নাতনি। জীবনের প্রান্ত বয়সে হাসিখেলে বাকি সময়টুকু পার করবেন। ‘আপনজন’ তাদের অবহেলা করতে পারে, আশ্রিতের মতো থাকতে হতে পারে। অপার স্নেহের বন্ধনে বিচ্ছেদও ঘটতে পারে। প্রিয়জনের এমন আচরণে কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারেন। চোখের কোণ থেকে অবচেতনেই গড়িয়ে পড়তে পারে দু’ফোঁটা অশ্রু। এসব বয়স্ক ব্যক্তির কথা ভেবে প্রায় পৌনে দু’বছর আগে সরকার দেশে প্রথম বারের মতো সব শিশু পরিবারে ৬৫ বছরের উর্ধে বয়স্কদের আবাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। প্রতিটি শিশু পরিবারে দশটি করে আসন বয়স্কদের জন্য সংরক্ষণ করা আছে। যে শিশু পরিবার শুধু মেয়েদের জন্য সেখানে শুধু বৃদ্ধাগণ থাকতে পারেন। বগুড়ার শিশু পরিবারটি বর্তমানে শুধু মেয়েদের জন্য। ১৯৫৯ সালে কয়েকটি ঘর নিয়ে নগরীর উত্তরে ফুলবাড়ি এলাকায় মহাসড়কের ধারে শিশু পরিবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আগে নাম ছিল সরকারী এতিমখানা। ১৯৬২ সালে ১৩ দশমিক ২২ একর ভূমির ওপর ইমারতের অবকাঠামো নির্মিত হয়। নাম হয় সরকারী শিশু পরিবার। অবকাঠামো স্থাপনা ছাড়াও এর মধ্যে আছে সুপ্রশস্ত সড়ক, বড় মাঠ, শিশু বিনোদনের স্থান, আম-কাঁঠাল ও ফলফলাদির বাগান। তিনটি বড় পুকুর। যার একটি সান বাঁধা। ১৯৮৪ সাল থেকে বগুড়া শিশু পরিবার শুধু এতিম মেয়েদের নিবাসী করা হয়। উল্লেখ্য, যারা শিশু পরিবারে থাকে তাদের বলা হয় নিবাসী। সবচেয়ে পুরনো এই শিশু পরিবারে মোট আসন ১শ’৭৫। মেয়ে নিবাসী আছে ১শ’৬৩ জন। যারা প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করছে। অনেকেই উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ গান নাটক খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় সুনাম কুড়িয়েছে। এর মধ্যেই ৬৫ বছরের উর্ধে নারীদের বৃদ্ধাশ্রমের দশটি আসন সংরক্ষণ করা হয়। প্রচারের অভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাদের অনাগ্রহের কারণে ফাঁকাই থেকে যায়। এখনও কোন বয়স্কা নারী আশ্রমে থাকার জন্য আসেনি। দুই একজন এসে খোঁজ খবর নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বগুড়া সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম খাঁন জানান, বগুড়া শিশু পরিবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহের মধ্যে। এখানে বয়স্করা জীবনের প্রান্ত বয়সে শিশুদের সঙ্গে থেকে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। তাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, কাপড় ও আনুষঙ্গিক সব কিছুই সরকার বহন করবে। সুপরিসর জায়গা, গাছগাছালি, পুকুরঘাট সবই আছে। টেলিভিশন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। নিজের বাড়ির মতো পরিবেশ সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের প্রতিটি শিশু পরিবারেই এমন ব্যবস্থা আছে। তিনি বললেন, অনেক সময় রক্তের সম্পর্ক স্নেহের সম্পর্কের কাছে হার মানে। শিশু পরিবারে থাকার সময় তারা এতিম শিশুদের কাছ থেকে ভালবাসা পাবেন। কারণ ওইসব নিবাসী শিশুদের কারও বাবা নেই, কারও মা নেই। কারও মা বাবা কেউ নেই। তারাও বয়স্কদের পেয়ে আপনজন হিসেবে গ্রহণ করবেন। স্নেহ ভালবাসার এই পরিবেশে আপনজনের ভালবাসা বঞ্চিত প্রবীণরা আনন্দের মধ্যে শেষ জীবনের বাকি সময়টুকু কাটাতে পারবেন। খোঁজ খবর করে জানা যায়, বয়স্ক নারীর ‘হোম সিকনেস’ এতটাই বেশি যে নিজের ঘর ছেড়ে আসতে চায় না। তার প্রতি সন্তানের অবহেলা থাকার পরও সন্তানকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। বগুড়া সোনাতলা এলাকার প্রায় ৭০ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধা নাম প্রকাশ না করতে চেয়ে যা বললেন তার অর্থ এই রকম- চার ছেলেমেয়ের সকলেই বিবাহিত। কোন সময় ছেলের সংসারে কোন সময় মেয়ের সংসারে থাকতেন। এক সময় লক্ষ্য করলেন কখনও ছেলে কখনও ছেলের বৌ ও মেয়ের জামাই তাকে ভাল দৃষ্টিতে দেখছে না। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে স্বামীর ভিটায় ফিরে এলেন। সেই ভিটার ওপর দৃষ্টি ছেলেদের। শত অবহেলার পরও তিনি সন্তানদের ছেড়ে যেতে চান না। আবেগের সুরে বললেন ‘ওরা তো আমারই ছেলেমেয়ে। ওরা তাড়িয়ে দিলেও মা কি কখনও সন্তানকে ফেলতে পারে।’ দীর্ঘশ্বাসে বললেন তবু সেখানেই থাকবেন। শিশু পরিবারে থাকার কথা বললে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ‘না’ সূচক জবাব দিলেন। এই বিষয়ে শিশু পরিবারের উপ তত্ত্বাবধায়ক বললেন, তিনি চেষ্টা করেছেন এমন বয়স্ক নারীদের শিশু পরিবারে আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে। পারেননি। ব্যর্থ হয়েছেন। এমনও হতে পারে, যারা আসতে চায় তারা শিশু পরিবারে যে তাদের আবাসনের সঙ্গে খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে তা জানেন না। সরকারী ও বেসরকারী কোনভাবেই প্রচার না থাকায় একাকিত্বের বয়স্করা শিশু পরিবারের যাচ্ছেন না। তিনি জানান, শিশু পরিবারের শিশুদের জন্য যে বরাদ্দ বয়স্কদের জন্য একই বরাদ্দ। প্রতিজন নিবাসীর জন্য মাসে বরাদ্দ আছে ২ হাজার ৬শ’ টাকা। এর মধ্যে খাবারের জন্য বরাদ্দ ২ হাজার টাকা। বাকি বরাদ্দ অর্থ অন্যান্য খরচের জন্য। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলের নাস্তা, দুপুর ও রাতে ভাত খাবার দেয়া হয়। যাতে পুষ্টিযুক্ত খাবার পায় সে জন্য মাছ, মুরগি, দুধ, সবজিসহ উন্নতমানের খাবার দেয়া হয়। চিকিৎসার জন্য খ-কালীন একজন চিকিৎসক আছেন। সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম খাঁন জানালেন শিশু পরিবারে বয়স্করা থাকতে পারলে উন্নতমানের পরিবেশেই পাবেন। একটা ফ্যামিলি বন্ডিং তৈরি হবে।
×