ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এবার সিটওয়ে থেকে ৭০ রোহিঙ্গার সমুদ্র পাড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৭ এপ্রিল ২০১৮

এবার সিটওয়ে থেকে ৭০ রোহিঙ্গার সমুদ্র পাড়ি

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সাগর পথে রোহিঙ্গাদের আরেকটি দল অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছে। ৭০ রোহিঙ্গা বোঝাই বড় আকৃতির একটি ইঞ্জিনচালিত নৌযানযোগে এসব রোহিঙ্গা পাড়ি জমিয়েছে আকিয়াব থেকে। গত ১২ এপ্রিল ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি সিটওয়ে (সাবেক আকিয়াব) থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশেই রওনা দিয়েছে বলে ওপারের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। উল্লেখ্য, এর আগে একই কায়দায় একই পথে ৫৬ রোহিঙ্গার একটি দল পাড়ি জমিয়েছে এ পারের টেকনাফ সীমান্ত উপকূল দিয়ে। মূলত এদের সকলের গন্তব্য মালয়েশিয়া। রোহিঙ্গাদের সাগর পথে নেয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যরা। এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় ছয় হাজার এবং উখিয়া-টেকনাফে নতুন আশ্রিত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাদ দিয়ে একটি মাত্র পরিবার রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ঘটনাটি সীমান্তের উভয়পাড়ের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সীমান্ত এলাকা বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী রোহিঙ্গা চেয়ারম্যান আকতার আলম আগে থেকে সেদেশের প্রশাসনের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনিও তার পরিবারের সদস্যরা জিরো লাইন সংলগ্ন এলাকা থেকে ফিরে গেছে। এপার থেকে নয়। ওপারের জিরো লাইন সংলগ্ন তুমব্রু এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করার পেছনেও রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তার নিকটাত্মীয়রা তুমব্রু এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তাদের সহযোগিতায় চলে যাওয়া আকতার আলমের প্রতিটি রোহিঙ্গা শিবিরে বিচরণ ছিল। চলাফেরা করতেন রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতেন ওপারের প্রশাসনের সঙ্গে। স্থানীয় সূত্রগুলো আরও জানায়, যেহেতু তিনি মিয়ানমারের বাসিন্দা তাই মিয়ানমারিজ ভাষায় আলাপ করতেন বলে এ বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন সন্দেহ করেননি। এখন সন্দেহ করা হচ্ছে- ওই আকতার আলমকে দিয়ে দেশটির টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমে মিথ্যা প্রচার চালানো হতে পারে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে এমনিতে নানা টালবাহানা করছে মিয়ানমার সরকার। তাছাড়া আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের আরসা-আরএসওর অস্তিত্ব রয়েছে বলেও আকতার আলমকে দিয়ে জবানবন্দী প্রচার করানো হতে পারে বলে সন্দেহের দানা বেঁধেছে। রোহিঙ্গা নেতারা মনে করছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি হয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে বাংলাদেশকে জানিয়ে করতে হবে। তবে চুপিসারে একটি মাত্র পরিবারকে নিয়ে যাওয়া মানে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি করা। অপরদিকে ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের বর্ডারগার্ড পুলিশ (বিজিপি) ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে সৌজন্য বৈঠকে পাকিস্তানের এক সন্ত্রাসী (জঙ্গী) রোহিঙ্গা শিবিরে আছে বলে অভিযোগ করা হয় বিজিপির (বর্ডারগার্ড পুলিশ) পক্ষ থেকে। তাৎক্ষণিক টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ আছাদুদ-জামান চৌধুরী বিজিপি প্রতিনিধিদলকে বলেন, কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ এদেশের মাটিতে সুযোগ পাবে না এবং এদেশ থেকে অন্য দেশের ক্ষতি করবে বাংলাদেশ তা কখনও চায় না। রোহিঙ্গা শিবিরে কোন সন্ত্রাসী নেই বিষয়টি বিজিবির পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐ বৈঠক শেষে ফিরে যাবার একদিন পর গত শনিবার মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও বিজিপি ওই আকতার আলমের পরিবারকে স্বাগত জানিয়ে ফটোসেশন করিয়ে দেশটির মিডিয়ায় প্রচার করানো হয়েছে। রোহিঙ্গা থাব্যে ॥ রোহিঙ্গা নেতাদের পক্ষে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে কিছু থাব্যে (দালাল) রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা অব্যাহতভাবে নির্যাতিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অন্তর্কোন্দল ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে থাব্যেগিরী অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক স্বজাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত। শক্র পক্ষের প্রলোভনে পড়ে জাতির ক্ষতিসাধন করতে দ্বিধাবোধ করেনা থাব্যেরা। অর্থকড়ি ও সাময়িক ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে আত্মঘাতী কাজ করে এরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে থাকে। আরেক শ্রেণীর লোক আছে যারা অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না। কোন রোহিঙ্গা নিজের শ্রম ও মেধা খরচ করে স্বাবলম্বী হলে কিভাবে তার ক্ষতি সাধন করবে এমন চিন্তায় সারাক্ষণ মগ্ন থাকে ওসব রোহিঙ্গারা। এই দুই শ্রেণীর লোকই আত্মঘাতী ও বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে জড়িত। আকতার আলম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এহেন দুর্দশার মধ্যেও মিয়ানমারের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেছেন বলে রোহিঙ্গা নেতারা মনে করছেন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, লাখ লাখ রোহিঙ্গার যৌক্তিক দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কথায় রাতের আঁধারে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন নিজ দেশের অভ্যন্তরে। মিয়ানমারের প্রশাসনের থাব্যে (দালাল) হয়ে আগেও কাজ করতেন বলে ঐ আকতার আলমের অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত থাকায় কৌশলে বলিবাজার এলকার হুক্কাটা (চেয়ারম্যান পদ) নিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। চাঁদাবাজি, দালালি, মাদক ব্যবসা ও লুটের মাধ্যমে গাড়ি বাড়ির মালিক হয়ে যান রাতারাতি ওই আকতার আলম। ২০১৭ সালের আগস্টে সেনা তা-ব চালাকালীন রোহিঙ্গারা দেশ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মনে করেছিলেন তাকে সুরক্ষা দেয়া হবে। কিন্তু এক সময় তাকেও দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তারপরও তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। পরিচিত সেনা, পুলিশ ও বিজিপি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। যেহেতু তার কাছে আগে থেকে সেনা ও বিজিপি কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর ছিল। সেহেতু রোহিঙ্গাদের ও বাংলাদেশের প্রশাসনের খবরাখবর মিয়ানমারের কাছে নিয়মিত প্রেরণ করতেন এই আকতার আলম। আশ্রয় গ্রহণকারী কিছু রোহিঙ্গাদের মতে, আকতার আলম মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে সীমান্ত এলাকার খবর সরবরাহ করতেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদ ও চলন বলন ছিল সন্দেহ করার মতো। তাকে যারা দেখেছে, তাদের কারোই মনে হয়নি তিনি নির্যাতনের শিকার হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। নো-ম্যান্স ল্যান্ডের ঝুপড়িতেও ছিলেন না তিনি। সোমবার দেশটির সকল সংবাদপত্রে খবরের শিরোনাম হন ওই আকতার আলম পরিবারের স্বেচ্ছায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। প্রচার করা হয়েছে, রাখাইন রাজ্য নিরাপদ বলেই প্রথম একটি রোহিঙ্গা পরিবারের প্রত্যাবাসন হয়েছে। আকতার, তার স্ত্রী সাজেদা বেগম, মেয়ে তাহেরা, ছেলে তারেক আজিজ এবং তাদের প্রতিবেশী শওকত আরা স্বদেশে চলে গেলেও আকতারের দুই ছেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখনও নো-ম্যান্স ল্যান্ডে রয়ে গেছে। রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছে, আকতার আলমকে মিথ্য প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে গেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে আকতার আলমকে ব্যবহার করবে সেনাবাহিনী।
×