বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে সহায়তা চায়। সরকারী চাকরির অপেক্ষায় না থেকে তরুণরা যাতে নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে সেজন্য তাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের আহ্বান জানান তিনি।
রবিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁয়ে আউটসোর্সিং খাতে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে দেশে তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত দুই দিনব্যাপী বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জয় আরও বলেন, ‘চাকরির জন্য আর সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। সরকারের কর্ম পরিকল্পনার কারণে ছেলে মেয়েরা মফস্বল শহরে বসে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার ডলার আয় করছে। সরকার বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও উচ্চগতির ইন্টারনেট দিচ্ছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।’
সরকারী চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে সম্প্রতি শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা সারাদেশে কোটা আন্দোলন দেখলাম। তরুণদের দাবি মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবারের মতো কোটা পদ্ধতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর জনপ্রশাসনে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার লোককে নিয়োগ দেয়া যায়। সংখ্যায় এটা একেবারেই নগণ্য। এর চেয়ে বেশি চাকরিপ্রার্থীকে কিন্তু আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই চাকরি দিতে পারি। তরুণদের বলব, সরকারী চাকরির দিকে এত না ঝুঁকে আইটি সেক্টরের দিকেও ঝুঁকতে পারো।’
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নানা প্রশিক্ষণের কথা তুলে ধরে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, প্রতিবছর আমরা এখন ৩০ হাজার তরুণকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আগামী ২০২১ সালে আমরা এক লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণ দেয়ার টার্গেট নিয়েছি। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর এই তরুণরা জনশক্তিতে পরিণত হবে। বাক্য ও বেসিস এই তরুণদের মধ্যে থেকে কর্মী বাছাই করে নিতে পারে। তিনি বলেন, আমরা একটি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলব, যেন তরুণরা প্রশিক্ষণের পর নিজেরাই একেকজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন। এখন এটা আমি বলতে পারি, ফ্রিল্যান্সার খাতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের এক নম্বর গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। তাই শুধু ইন্টারনেট আর ল্যাপটপ থাকলেই হলো। আমরা দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবাও নিশ্চিত করব। যে কেউ যেকোন স্থানে বসে আইটি সেক্টর থেকে উপার্জন করতে পারবেন।
কিছুদিন আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের উদ্যোগে ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবার উদ্বোধন করেন জয়। দ্রুত গতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করায় বিপিও খাত থেকে বাক্য প্রতিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে এক লাখ তরুণের কর্মসংস্থান হবে বিপিওতে। এই খাতে দশ বছর আগে যেখানে আমরা মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলার আয় করতাম, সেখানে এখন আমরা ৮ বিলিয়ন ডলার আয় করতে শুরু করেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই সরকার প্রোগ্রামিং প্রশিক্ষণের কথা ভাবছে।
সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণদের আসক্তি ক্রমেই বিপদের কারণ হয়ে উঠছে। বিশাল শক্তির আধার এই তরুণরা, সমাজের প্রতি তাদের অনেক দায়িত্বও রয়েছে। তাদের ইন্টারনেট আসক্তি দেখে এখন আমাকে বলতে হয়, ফেসবুক এখন অনেকের কাছে একটা ফেকবুক। ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা, বিদ্বেষপূর্ণ তথ্য ও মন্তব্য প্রচারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জয় বলেন, বাংলাদেশে বসে গোটা ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা যদি এ মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেই, তো সবাই আমাদের তীব্র সমালোচনা করবেন। আর এটা ঠিকও হবে না। একটা ওয়েবসাইট বন্ধ করব, আরও দশটা ওয়েবসাইট দশ মিনিটে তৈরি হয়ে যাবে। একটা ফেসবুক পেজ বন্ধ করে দিলে আরও দশটা ফেসবুক পেজ তৈরি হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ইন্টারনেটে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য যা সমাজে সংঘাত ডেকে আনে, তাকে কোনভাবেই মুক্তবাক বলা যাবে না। এটা কোনভাবেই সমর্থন করা যাবে না। ডাক-টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ডিজিটাল এ্যাক্টের খসড়া তৈরি করে ফেলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোন একটি গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, মিথ্যা অপপ্রচারকে আমরা কোনভাবেই গ্রাহ্য করব না। গোটা বিশ্বের মতো আমরাও সাম্প্রদায়িক সংঘাতপূর্ণ বক্তব্যের বিরুদ্ধে অবস্থান করছি। ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে কেউ যেন সংঘাত ছড়াতে না পারে সেজন্য আমরা আরও কড়া অবস্থানে যাচ্ছি। তিনি তরুণদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক থাকারও অনুরোধ করেন।
বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয় আরও বলেন, অনেকেই ফেসবুককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। আমার স্ত্রী ক্রিস্টিনা একটু পরপরই ফেসবুক চেক করে। আমি এটাকে ফেকবুক বলি। এটা একটা কাল্পনিক, মিথ্যা জগৎ। এর কোন সীমা নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ব্লক করাও সম্ভব নয়। ইন্টারনেটে কোন কিছু ব্লক করে আটকানো যায় না। ব্লক করতে আপনারাও চাইবেন না। ফেসবুকে অপপ্রচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। এটা কারো দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।
তিনি বলেন, যেসব কনটেন্টের মাধ্যমে অপ্রপ্রচার চালানো হয় বা কালো তালিকাভুক্ত কনটেন্টগুলো কীভাবে ব্লক করা যায় তার জন্য প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এগুলো ব্লক করা হবে। কেননা এসবের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের উস্কানি দেয়া হয়। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে উস্কানি দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ফেসবুকে কারো মন্তব্য করা তার বাক স্বাধীনতা। কিন্তু এর মাধ্যমে উস্কানি দেয়া উচিত নয়। আমাদের সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি খসড়া করে ফেলেছে। এর মাধ্যমে কারো বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, উস্কানি রোধ এ আইনের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, স্বাধীন মতপ্রকাশ বন্ধ করতে ডিজিটাল আইন করা হয়নি বরং সংখ্যালঘুদের রক্ষা করাসহ বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করতেই এ আইন করা হয়েছে। সম্মেলনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সন্তোষ প্রকাশ করেন সজীব ওয়াজেদ জয়।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী, বাক্য সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ প্রমুখ।
বিপিও সম্মেলনের আয়োজক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কলসেন্টার এ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্য)। আয়োজকরা জানিয়েছে, এবার আউটসোর্সিং সেবা, পরবর্তী প্রজন্মের ধারণাগুলো উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই সময়ের আলোচিত সেবার বিষয়গুলো নিয়ে হচ্ছে আলোচনা। সামিট সফল করার জন্য সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ্যাক্টিভেশন কার্যক্রম। দেশী-বিদেশী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, সরকারের নীতিনির্ধারক, গবেষক, শিক্ষার্থী এবং বিপিওখাতের সঙ্গে জড়িতরা এতে অংশ নিচ্ছে। এবারের আয়োজনে দেশের আউটসোর্সিং খাতকে আরও কিভাবে ভালো করা যায়- সে বিষয় বিশ্বকে জানানো হচ্ছে।
সরকারের রূপকল্প- ২০২১ বাস্তবায়নে বিপিওখাতের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরা হচ্ছে। বিপিওখাতে দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবল তৈরি এই সামিটের অন্যতম লক্ষ্য। এতে ২০২১ সালের মধ্যে ৪ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এ আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- এই আশা করছেন আয়োজকরা। সম্মেলনে ৪০ জন স্থানীয় বক্তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ২০ জন আন্তর্জাতিক বক্তা; সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হবে ১০টি সেমিনার। এবারের আয়োজনে আউটসোর্সিং সেবা ও ফোর-জি, ফাইভ-জি নিয়ে ধারণা প্রদর্শন করা হবে। আয়োজনে অংশীদার হিসেবে রয়েছে বেসিস, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, বাংলাদেশ ওমেন ইন টেকনোলজি, আইএসপি এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন।