ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টঙ্গী স্টেশনের কাছে কমিউটার ট্রেন লাইনচ্যুত ॥ নিহত ৫, আহত ৪০

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৬ এপ্রিল ২০১৮

টঙ্গী স্টেশনের কাছে কমিউটার ট্রেন লাইনচ্যুত ॥ নিহত ৫, আহত ৪০

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জামালপুর থেকে ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার ট্রেন টঙ্গী রেল স্টেশনের কাছে নতুন বাজার এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে ৫ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৪ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য গুরুতর আহত শাহাদাত মিয়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আনা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শাহাদাত হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহ। নিহতদের সবার পরিচয় জানা যায়নি। বেলা সোয়া ১২টার দিকে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের আউটার সিগন্যালের কাছে লাইন ক্রসিংয়ের সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাত্র ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে একই রেল স্টেশনে আবারও ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। এর ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর বেলা পাঁচটার দিকে রিলিফ ট্রেন এসে আপ লাইন ক্লিয়ার করার পর রেশনিং পদ্ধতিতে এক লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করে। তবে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে বলে জানা গেছে। অপর একটি সূত্র জানায়, ভুল সিগন্যালিংয়ের কারণেও এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে রেল কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় দুর্ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে কমিটিকে কারণ খতিয়ে দেখে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে। এদিকে, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) যান রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। এ সময় সঙ্গে ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার একেএম নাসির উদ্দিন। রেল মন্ত্রণালয় আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। এছাড়া নিহতদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হবে বলে জানা গেছে। ঢামেকে চিকিৎসারত বাকিরা হলেন- বাদল (২৮), সবুজ (৪০), ইসরাফিল (১২), আলমগীর (৩২) এবং ফরিদ (২৮)। ডাক্তারের বরাত দিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই বাচ্চু মিয়া জানান, আহতদের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। এর আগে ঘটনাস্থলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিক তথ্যে তাদের মনে হয়েছে, সিগন্যাল ম্যান সংকেত দিতে দেরি করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোঃ মিয়া জাহান জানান, বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস ওই দুর্ঘটনার কারণে আটকে ছিল। লাইন ক্লিয়ার হওয়ার পর বিকেল সাড়ে ৫টায় ট্রেনটি টঙ্গী অতিক্রম করে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে টঙ্গী ফায়ার সার্ভিস, টঙ্গী থানা পুলিশ ও রেল পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং উদ্ধার কাজ শুরু করে। বেলা পাঁচটার দিকে লাইনচ্যুত হওয়া কোচগুলো লাইনে তোলা হয়। নিহতদের মধ্যে তিনজনের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ে ও অপর একজনের বাড়ি জামালপুর। শব-ই-মিরাজ এবং পহেলা বৈশাখ পালন করে দেশের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন বলে জানা গেছে। নিহতরা সবাই ট্রেনের ছাদে উঠে ঢাকায় আসছিলেন বলে জানা গেছে। লাইন ক্রসিংয়ের সময় ছাদে থাকা যাত্রীদের ভয়ে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যেতে দেখা গেছে। দুর্ঘটনার পর নিহতদের লাশ কমলাপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ঘটনায় আহতদের টঙ্গী সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এছাড়া গুরুতর আহত ৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ন কবীর, গাজীপুর পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ এবং গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল এবং জেলা আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি আজমত উল্লা খান ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আহতদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় আলমগীর হোসেন (২৩), শরিফ (২৫), ই¯্রাফিল হোসেন (১৩), বাদল মিয়া (৫৫), হালিমা আক্তার (৩৩), মনির হোসেনকে (৩২) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সাজ্জাদ হোসেনকে (২৬) পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া বিপ্লব হোসেন (২৫), শাহিন (১৮), ফিরোজ মিয়া (৩৫), লিয়াকত হোসেন (৪০), আব্দুর রাজ্জাক (৩৮), নজরুল ইসলাম (৬৫) ও আবু সাঈদকে (২৫) টঙ্গী সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং ১২ জন আহত যাত্রীকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং অন্য আহতরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। জনকণ্ঠের টঙ্গী প্রতিনিধি জানান, দুর্ঘটনায় নিহত আবির হোসেন (৪৪) জামালপুরের বাসিন্দা। ঢাকার বেগুনবাড়িতে সে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। শব-ই-মিরাজ এবং পহেলা বৈশাখ পালন করে দেশের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিল। দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশের এমন অবস্থা হয়েছে যে, তাদের চেনার কোন উপায় ছিল না। লাশগুলো দলিত-মথিত হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা জামালপুর কমিউটার ট্রেনটি দুপুর সোয়া ১২টার দিকে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের ২ নম্বর লাইন দিয়ে ঢাকায় ঢুকছিল। এ সময় ট্রেনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। বগিগুলো লাইন থেকে আছড়ে পড়লে ওই বগিতে থাকা কয়েকজন যাত্রী ছিটকে নিচে রেল লাইনে পড়ে এবং ওই ট্রেনেই কাটা পড়ে চারজনের দেহ খন্ড বিখন্ড হয়ে যায় ও ৪০ যাত্রী আহত হন। পরে বিকেল ৫টার দিকে লাইনচ্যুত হওয়া ট্রেনের বগিগুলোকে টেনে লাইনের ওপরে তোলা হয় ও সারাদেশের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক করতে রেশনিং পদ্ধতিতে এক লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করে রেল কর্তৃপক্ষ। রেল স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার ট্রেনটি টঙ্গীর নতুনবাজার এলাকায় রেল সিগন্যাল পার হওয়া মাত্রই পেছনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জন মারা যান। এবিষয়ে টঙ্গী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে টঙ্গী সরকারী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মোঃ পারভেজ হোসেন বলেন, ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় আহত ২৬ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এদের মধ্যে গুরুতর ৭ জনকে ঢামেক ও পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ৭ জনকে এ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এবং ১২ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জিআরপি ওসি ইয়াসিন ফারুক জনকণ্ঠকে জানান, ট্রেনটি ক্রসিংয়ের সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাকবলিত জামালপুর কমিউটার ট্রেনের টিসি মাসুদ জনকণ্ঠকে জানান, টঙ্গী স্টেশনে ট্রেনটি আসার পর ২ নম্বর লাইন দিয়ে ট্রেনটি ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এ সময়ে পেছনের কয়েকটি বগিতে প্রচ- ঝাঁকুনি অনুভব হয়। এর পরপরই ২ নম্বর লাইন থেকে পেছনের কয়েকটি বগি ১ নম্বর লাইনে চলে যায় এবং বিকট শব্দে ট্রেনের বগিগুলো দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যায়। যাত্রীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে। আমি নিচে নেমে দেখি ৩/৪ জন যাত্রী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মরে গেছে এবং অনেক যাত্রী আহত হয়েছে। টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের মুখপত্র আতিকুর রহমান জানান, লাইন পরিবর্তনের সময় পেছন থেকে পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। তখন আতঙ্কিত হয়ে ছাদ থেকে অনেকে লাফিয়ে পড়েন। ১৫ থেকে ২০ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুর্ঘটনার পর নিহত আমির উদ্দিনের (৩৫) ভাই ও একই ট্রেনের যাত্রী জামাল উদ্দীন বলেন, তিনজনেরই বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের মশাখালী এলাকায়। আমরা সবাই রিক্সা চালাই। আমরা গফরগাঁওর মশাখালী থেকে সকাল ৯টার সময় ট্রেনটিতে উঠি। গরিব মানুষ বলে টিকিট কাটতে পারিনি। তাই দুই ভাই ছাদে উঠি। আমাদের সঙ্গে আরও ৮ জন ছিল। সবার মুখ চিনি কিন্তু নাম জানি না। অন্য যে দুজন মারা গেছেন তারাও আমাদের এলাকার ও এই ৮ জনের দলের মধ্যেই ছিলেন। তারা সবাই ঢাকায় রিক্সা চালাতে আসছিলেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ ট্রেনটা খুব ঝাঁকি খেতে থাকে। ভয় পেয়ে ওরা কয়েকজন লাফ দেয়। আমি ট্রেনের দরজার হাতল ধরে থাকি। তখন দেখতে পাই ওরা লাফ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ওপরে পেছনের বগিটা উঠে যায়। সেটায় কাটা পড়ে যায় তারা। অনেকে ধাক্কা খায়। জামাল উদ্দীন জানান, নিহত আমির উদ্দিনের স্ত্রী ও তিন ছেলে রয়েছে। ঢাকায় রিক্সা চালাতে আসার আগে তিনি ফুলের তোড়া বানানোর কাজে ব্যবহার করা কামিনী ফুলগাছের পাতা সরবরাহের ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় খুব একটা সুবিধা না হওয়ায় ঢাকায় আসছিলেন। উল্লেখ্য, গত শনিবার রাত ৮টার দিকে ঢাকা থেকে আখাউড়াগামী ১ নম্বর লাইনে তিতাস কমিউটার ট্রেনের ২টি বগি লাইনচ্যুত হয়। পরে তিন ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এর কিছুদিন পূর্বেও একই স্থানে দিনাজপুরগামী দ্রুতযান এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। এদিকে দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আরিফুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
×