ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উৎসবে লাখো মানুষের ঢল, দৃষ্টি কাড়েন দুই ফরাসী বলী

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৮

উৎসবে লাখো মানুষের ঢল, দৃষ্টি কাড়েন দুই ফরাসী বলী

হাসান নাসির ॥ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন শনিবার চট্টগ্রামে প্রাণের উৎসবে মেতেছিল নারী পুরুষ, শিশু কিশোর নির্বিশেষে সব বয়সের এবং সব শ্রেণী পেশার মানুষ। লাখো মানুষের ঢল নামে চট্টগ্রাম নগরীর বর্ষবরণ উৎসবগুলোকে ঘিরে। সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মহাসম্মিলন ঘটে নগরীর ডিসি হিল, সিআরবি শিরিষতলা এবং পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় বলীখেলা, যেখানে দৃষ্টি কাড়েন দুই ফরাসী বলী। দিনভর নানা আয়োজনে অতিবাহিত হয় বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। উচ্চারিত হয় একটি সুখী সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার শপথ। বরাবরের মতো এবারও নগরবাসীর প্রধান আকর্ষণ দৃষ্টিনন্দন ডিসি হিল এবং সিআরবি শিরিষতলা। এবারও গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল শাহাবুদ্দিনের বলীখেলা। নিরাপত্তাজনিত কারণে সন্ধ্যার আগেই অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা ছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মঞ্চে ছিল একটানা অনুষ্ঠান। দলীয় সঙ্গীত, একক সঙ্গীত, নৃত্য, বংশীবাদনসহ নানা আয়োজন দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। এছাড়া পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতেও হাজারো মানুষের ঢল নামে। ডিসি হিলে ছিল রক্তকরবী, সঙ্গীত ভবন, জয়ন্তী, ছন্দানন্দ, সাংস্কৃতিক পরিষদ, গুরুকূল সঙ্গীত একাডেমি, সঙ্গীত সাধনা, সঙ্গীতালয়, গীতধ্বনি, সজামি সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ইমন কল্যাণ, সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ, রাগেশ্রী, খেলাঘর আসর, বংশী শিল্পকলা একাডেমি, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের পরিবেশনা। আগের দিন বিকেলে বর্ষ বিদায় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বরণ অনুষ্ঠান। সিআরবি শিরিষতলায় ছিল বিদায় ও বরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলতে সেখানে আয়োজিত হয় কাবাডি ও বলীখেলা। সকালে সেতু-আশরাফুল হক স্মৃতি কাবাডি টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক। উপস্থিত ছিলেন নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক স্বপন মজুমদার, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, মোঃ সাহাবউদ্দিন, শওকত ইকবাল প্রমুখ। বর্ষ বিদায় আয়োজনে ছিলেন নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সভাপতি ডাঃ চন্দন দাশ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চন্দন কান্তি দাশ প্রমুখ। সিআরবিতে আকর্ষণীয় আরেক আয়োজন সাহাব উদ্দিনের বলীখেলা। এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। ফাইনাল রাউন্ডে তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার কলিমউল্লাহ বলীকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হন। বিজয়ী শাহজালাল বলীর হাতে নগদ ২০ হাজার টাকা এবং রানার্সআপ কলিমউল্লাহ বলীকে ১০ হাজার টাকা ও ট্রফি প্রদান করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। রিংয়ে ২ ফরাসী বলী ॥ শাহাবুদ্দিনের বলীখেলা দেখতে এসে একপর্যায়ে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি দুই ফরাসী নাগরিক। জামা কাপড় খুলে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তারা উঠে পড়েন বলীখেলার রিংয়ে। এই দু’জনের নাম জুমার্কা ও জুসিকা। এ সময় করতালিতে মুখরিত হয় ওই স্থান। নানা ভঙ্গিমায় হাত উঁচিয়ে তারা জানিয়ে দেন যে, একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে চান। এ সময় বলীখেলার সঞ্চালক কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী এ দুই ফরাসী বলীকে স্বাগত জানান। প্রথমে বলীখেলার রেফারি আবদুল মালেক তাদের খেলার নিয়ম বুঝিয়ে দেন। এরপর শুরু হয় তাদের মধ্যে লড়াই। এ লড়াইয়ে জয়ী হন জুমার্কা। শেষ পর্যন্ত ফরাসী বলী চ্যাম্পিয়ন না হলেও শাহাবুদ্দিনের বলীখেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলেন। বিজয়ী জুমার্কা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সপ্তাহখানেক আগে দুই বন্ধু ফ্রান্স থেকে বেড়াতে এসেছে বাংলাদেশে। দেখে এলাম বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। এরপর চট্টগ্রামে এসে অনুভব করলাম উৎসব আমেজ। জানলাম এদেশে বাংলাবর্ষকে বরণ করা হয় মহাআয়োজনে। প্রচুর মানুষের ভিড় দেখে উৎসুক হিসেবে ঢুকে পড়ে দেখি রেসলিং হচ্ছে। নিজের আবেগ থামাতে পারলাম না। এর রেসলিংয়ে অংশগ্রহণ করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বর্ষবরণে ছিল নানা আয়োজন। প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজন ছিল খুবই জমজমাট। উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, উপ-উপাচার্য ড. শিরিণ আখতার, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপস্থিতিতে চবিতে উদযাপিত হয় বর্ষবরণের উৎসব। ছিল বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। চট্টগ্রাম নগরী ছাড়াও জেলার প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত স্থানে ছিল বিভিন্ন ধরনের বৈশাখী আয়োজন। মেলা বসেছে হাট বাজার, বটতলা, হাটখোলায়। প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা। সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি পেয়েছে বর্ষবরণ, যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমাগম ঘটে। বৈশাখী মেলায় উঠে এসেছে বাঙালী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। বাঙালী জাতি শপথ নেয় একটি সুখী সমৃদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের।
×