ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বটতলার বৈশাখী মেলা ৫শ’ বছরের ইতিহাস

মেলা বাঙালীর সর্বজনীন উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

মেলা বাঙালীর সর্বজনীন উৎসব

নববর্ষের প্রথম দিনে আজি উৎসব রাতি, কৃষক পল্লী নব-আনন্দে উঠিয়াছে তাই মাতি, ‘আবার জমবে মেলা হাটখোলা-বটতলা।’ বাঙালী কবি মনের চিরন্তন এ উচ্চারণ বাংলাকে শুধু সমৃদ্ধই করে না বাংলাকে লালন করে বুকের গভীরে। তাই বুঝি প্রতিটি বাঙালীর অবচেতন মনে আছড়ে পড়ে ষোলোয়ানা বাঙালিয়ানার ঢেউ। প্রতি বছর বাংলা বর্ষ নানা ঢঙে, নানা রঙে, বর্ণ-বৈচিত্র্যে পালিত হয় প্রতিটি বাঙালীর ঘরে ঘরে। বৈশাখ মানে চির নতুন আর অনন্ত কালের আবাহন। পুরনো জীর্ণ সবকিছু বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়ার প্রত্যয়ে বৈশাখের জয়ধ্বনিতে কবিগুরু উচ্চারণ করেছেন ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ বৈশাখী মেলা বাঙালিয়ানার হাজার বছরের লালিত ইতিহাস। আর তা যদি হয় বটতলার বৈশাখী মেলা, তা হলে তো আবহমান বাংলা ও বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। প্রতি বছর বৈশাখী মেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা হয়ে ফিরে আসে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। মেলা লোক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা নববর্ষের প্রথম সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। যা ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-গঞ্জের হাটে-মাঠে-ঘাটে। বৈশাখে হাটখোলা-বটতলা মেলা বসবে এটা বাংলা ও বাঙালীর দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। বাংলা নববর্ষে মাদারীপুরের শহরে ও গ্রামাঞ্চলে যত বৈশাখী মেলা বসে তার অধিকাংশ বটতলা কেন্দ্রিক। বটতলার মেলায় আনন্দ-বিনোদনের কোন কমতি থাকে না। ঐতিহ্যগত আবেদন খুঁজে পাওয়া যায় এ সব মেলায়। এই বটতলার মেলায় প্রাণের স্পন্দন ও বাঙালিপনার ছোঁয়া পাওয়া যায়। আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য মাদারীপুর অঞ্চলে বৈশাখী মেলা বসে বটতলা, নিমতলা, হাজরাতলা, পাকড়তলা, বকুলতলা। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তি থেকে গ্রামীণ জনপদে এক শ্রেণীর দোকানি বাঁশ-খুঁটি পুঁতে তাঁবু বা পলিথিন টাঙ্গিয়ে মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি, রং বে-রঙের খেলনা সাজিয়ে ছোট্ট-ছোট্ট শিশু ছেলেমেয়েদের আকৃষ্ট করে। বাঁশি আর ঝুন্ঝুনি বাজিয়ে মানুষকে মেলায় আসার আহ্বান জানানো হয়। এভাবেই ভিড় বাড়তে থাকে এবং শুরু হয় লোক সমাগম। মানুষের কলরবে এবং নানা ধরণের বাঁশি, ভেঁপু আর ঝুন্ঝুনির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঘুরতে আসা সকল শ্রেণীর মানুষ নানা পণ্য কেনা-কাটা করে। নতুন পোশাকে সকল ধর্মের মানুষের সমাগম ঘটে বটতলার মেলায়। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় খাঁটি বাঙালী প্রাণের স্পন্দন। বাংলা নববর্ষে বৈশাখ মাসব্যাপী এ অঞ্চলের কোথাও না কোথাও মেলা বসে। নববর্ষে জেলার হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন পূজা-পার্বণের আয়োজন করে থাকে। সকল অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং নতুন বছরে দেশ ও জাতির কল্যাণে আয়োজিত নানা দেব-দেবীর পূজা উপলক্ষেও বৈশাখী মেলা বসে। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় অনুষ্ঠিত মেলায় ধর্ম বর্ণের কোন ভেদাভেদ থাকে না। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। তবে আগের তুলনায় বটতলায় মেলার আবেদন অনেকটা কমে এসেছে। কারণ ধর্মীয় গোড়ামি ও ধর্মীয় অন্ধত্ব মানুষকে পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ বর্তমান প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সব ধরনের মেলাকে দেখা হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ফতোয়া দিয়ে সমাজে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো এক শ্রেণীর মানুষ মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চায়। কিন্তু বাঙালীর প্রাণের উৎসব মেলার আয়োজন থেমে থাকেনি। কেউ কেউ মেলাকে ‘হিন্দুয়ানি’ অনুষ্ঠান বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু তাদের এ যুক্তি মানতে নারাজ সমাজ বিজ্ঞানীরা। তা ছাড়া মেলা ‘হিন্দুয়ানি’ অনুষ্ঠান এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ বাঙালীর উৎসব সার্বজনীন। মাদারীপুর শহরে জাঁকজমক বৈশাখী মেলা মেলা বসে লেকেরপাড় শকুনী বটতলা। পৌর এলাকার মধ্যে শকুনী বটতলার মেলা এ অঞ্চলের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী। শহরের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র এটি। লেকেরপাড় স্বাধীনতা অঙ্গনে রাতব্যাপী চলে সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান। মাদারীপুর অঞ্চলে বিভিন্ন গাছতলার মেলার ঐতিহ্য রয়েছে। কোন কোন বটতলা মেলার ইতিহাস ২শ’ বছব থেকে ৫শ’ বছরের। ১ বৈশাখ উপলক্ষে রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের চৌরাশী গ্রামে সিদ্ধেশ্বরী বটতলায় মেলা বসে। এ মেলা কবে কে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে প্রাচীন ও বয়োবৃদ্ধদের মতে এর ইতিহাস প্রায় ৫শ’ বছরের। কোন সিদ্ধ পুরুষ এ মেলার প্রচলন করেছেন বলে স্থানীয়দের ধারণা। ১ বৈশাখ সকালে পূজা-পার্বণ চলাকালীন থেকে সিদ্ধেশ্বরী বটতলায় মেলা শুরু হয়। রাত পর্যন্ত চলা এ মেলায় বাংলা ও বাঙালী প্রাণের স্পর্শ খুঁজে পাওয়া যায়। ফিরে পাওয়া যায় খাঁটি বাঙালী প্রাণের স্পন্দন। নববর্ষ উদযাপন, আনন্দ বিনোদন আর নানা পণ্য কেনাকাটা করতে কয়েক সহস্র মানুষের সমাগম ঘটে চৌরাশী সিদ্ধেশ্বরী বটতলার মেলায়। একই ধরনের মেলা বসে চৌরাশী গ্রামের পশ্চিম পাড়া বাধালিয়াবাড়ি বটতলায়। বাধালিয়াবাড়ি বটতলার মেলা নামে পরিচিত এই মেলার ইতিহাসও প্রায় ৫শ’ বছরের। প্রতি বছর ৪ বৈশাখ এ মেলা বসে। এ মেলায় পাওয়া যায় স্থানীয় কৃষিজাত পণ্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্পজাত সামগ্রী, শিশুদের মন ভুলানো মাটির সব ধরনের খেলনা, নানা ধরনের পোশাক, মেয়েদের পোশাক, বিভিন্ন ধরনের লোকজখাদ্য। যেমন চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, খাগড়া, লালী বাতাসা, চিনির তৈরি হাতি, ঘোড়াসহ নানা ধরনের মিষ্টি সামগ্রী বটতলার মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এ ছাড়া চৌরশী কাকৈরথোপা গ্রামে কৃষ্ণ মন্দির ও দুর্গা মন্দিরের সামনে বিশাল বটগাছ তলায় মেলা বসে। এখানে মেলা হয় একদিনের জন্য। পহেলা বৈশাখ পূজার পরদিন ২ বৈশাখ বটতলায় মেলা বসে। এ মেলায় পাওয়া যায় স্থানীয় কৃষিপণ্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্পজাত সামগ্রী, শিশুদের মন ভুলানো মাটির সব ধরনের খেলনা, নানা ধরনের পোশাক, মেয়েদের পোশাক, বিভিন্ন ধরনের লোকজখাদ্য। একই ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামে কালিবাড়ি বটতলা বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ বৈশাখ মেলা বসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। কালি মন্দির ও কৃষ্ণ মন্দিরের আঙ্গিনায় প্রতি বছর মেলার আয়োজন করে স্থানীয় ভক্তরা। একই উপজেলার খালিয়া বটতলা মেলা বসে বটগাছকে কেন্দ্র করে টেকেরহাট-কদমবাড়ি সড়কের উপর। বৈশাখের যে কোনদিন মেলার আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে চৌরাশী গ্রামের সুশীল ঠাকুরবাড়ি বটতলা ও লাউসার বটতলার মেলার আবেদন ছিল মানুষের মুখে মুখে। রাজৈর কালিবাড়ির বটতলার মেলা উল্লেখ করার মতো। দেড় শ’ বছরের পুরনো কালিবাড়ি বটতলার মেলার বিস্তৃতি ঘটে আশ-পাশের মাঠ ও পুকুরপাড় পর্যন্ত। অন্যদিকে রাজৈর উপজেলার হরিদাসদি গ্রামে কালিবাড়ি বটতলা ও পান্তাপাড়া বটতলা মেলা বসে ১ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত। এক সময় জেলার মধ্যে রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বটতলা, নিমতলা, হাজরাতলা, পাকড়তলা, বকুলতলা, শেওড়াতলা বৈশাখী মেলাসহ সব ধরনের মেলা বসতো। এখন গাছতলা কেন্দ্রিক মেলার সংখ্যা কমে গেছে নানা পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও পারিপার্শ্বিক কারণে। তবে বটতলার মেলা এ অঞ্চলের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সদর উপজেলার পেয়ারপুর (কুমড়াখালী) ভীমবাড়ি বটতলার মেলা, পাঠককান্দি কালিবাড়ি বটতলার মেলা, পুরান বাজার কালিবাড়ির বটতলার মেলা ছিল শহরের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ। আরও একটি মেলার সুনাম ছিল সর্বত্র। তা হলো সদর উপজেলার সিদ্ধিরখোলা মিত্রবাড়ির (শ্রীলেখা মিত্র, বর্তমানে ভারতীয় নায়িকা) বটতলার মেলা। পেয়ারপুর নগেন চৌকিদার বাড়ি বটতলার মেলা। বর্তমানে এসব বটতলার মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কোন কোনটার অস্তিত্ব টিকে আছে ঐতিহ্যগত কারণে। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×