ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাক্ষর জাল করে ৩১ একর জমি দখল

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

স্বাক্ষর জাল করে ৩১ একর জমি দখল

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১৩ এপ্রিল ॥ দেশের প্রখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরীর মৃত্যুর ৩৩ বছর পর তার ও স্বজনদের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় ৩১ একর জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খাদুলী গ্রামের কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী সাইফুল ইসলাম ওরফে সয়ফল ও তার ছেলে সৈয়দ গং স্বাক্ষর জাল করে এ জমি দখল করেছে। এ ঘটনায় সরকারের পক্ষে আদালতে মামলা করা হয়েছে। স্থানীয়রা অবিলম্বে স্বাধীনতাবিরোধীর ছেলে সৈয়দ গংদের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করেছে। জানা যায়, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড় পাঙ্গাসী ইউনিয়নের খাদুলী গ্রামের মৃত আবেদ আলীর ছেলে মৃত সাইফুল ইসলাম ওরফে সয়ফল জীবিত অবস্থায় একজন রাজাকার ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সয়ফলের সহযোগিতায় পাকবাহিনী খাদুলী গ্রামের দোকানপাট-বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর সয়ফল এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায়। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর সয়ফল আবারও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জাল ডিগ্রী ও জাল কাগজ তৈরি করে অন্যের জমি দখল করে। তারা প্রখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরী ও তার স্বজনদের স্বাক্ষর জাল করে সোলেনামা তৈরি করে ৩১ একর জমি দখল করে নেয়। প্রমথ চৌধুরী যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও তার পৈত্রিক নিবাস ছিল পাবনার চাটমোহর থানার হরিপুর গ্রামে। ওই সময় সিরাজগঞ্জ জেলা পাবনার একটি মহকুমা শহর থাকায় প্রমথ চৌধুরীরা খাদুলী গ্রামে বহু সম্পত্তি ক্রয় করেন। প্রমথ চৌধুরী ও তার স্বজনরা পাক-ভারত বিভক্তির পরেই জমিজমা রেখে ভারতে চলে যায়। সেখানেই প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু রাজাকার সাইফুল ইসলাম ওরফে সয়ফল ও তার বাবা আবেদ আলী প্রখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরীর মৃত্যুর ৩৩ বছর পর ১৯৭৮ সালের ১৪ নবেম্বর তার স্বাক্ষর জাল করে সোলেনামা তৈরি করেন। যার নম্বর-৩৩/৭৭। সেই সোলেনামার ভিত্তিতে উল্লাপাড়া সহকারী আদালত মামলা করে ডিগ্রী লাভ করেন (ডিগ্রী নং-৪৪/০১) এবং ২২ একর জমি দখলে নেন। তবে ওই সময় সরকার পক্ষের আইনজীবীর ব্যর্থতার কারণে জাল সোলেনামাটি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অন্যদিকে সরকার প্রমথ চৌধুরী ও তার স্বজনদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ‘ক’ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করে। এ অবস্থায় সয়ফলের ছেলে সৈয়দ আলী ২০১২ সালে প্রমথ চৌধুরীর জাল স্বাক্ষরকৃত সোলেনামা ও আদালতের ডিগ্রীমূলে পুনরায় অর্পিত ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু অদ্যাবধি আদালতে মূল কাগজপত্র জমা দেয়া হয়নি। অন্যদিকে, সরকার পক্ষে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক প্রমথ চৌধুরী ও তার স্বজনদের স্বাক্ষরকৃত জাল সোলেনামা (৩৩/৭৭) বাতিলের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এছাড়াও উল্লাপাড়ার সুজা গ্রামের বাসিন্দা হাজী মোঃ খবির উদ্দিন সুজা মৌজার ২৬ শতক ভূমি উল্লাপাড়া সহকারী জজ আদালত থেকে ডিগ্রীপ্রাপ্ত (নং-৩৪৬/৮৩) হয়ে স্বত্ব দখলীয় হয়। কিন্তু খাদুলী গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আলী আদালতের খবির উদ্দিনের ডিগ্রীর ৩৪৬/৮৩ নম্বর ব্যবহার করে খাদুলী মৌজার ৯ একর ১৪ শতক জমি দাবি করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাবর্তন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। (মামলা নং-২২৮৯/১২)। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। অনুসন্ধানে জানা যায়, সিএসএস খতিয়ানেও ৯ একর ১৪ শতক জমিও প্রমথ চৌধুরীদের ছিল। জাল হিসেবে ধরা পড়ায় জেলা প্রশাসক ডিগ্রী বাতিলের জন্য যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। (মামলা নং-৩০০/১৭)। শুধু সরকারী সম্পত্তিই নয় উল্লাপাড়ার খাদুলী গ্রামের শ্রী নরেশ চন্দ্র সরকার নামের এক ব্যক্তির জমিও উল্লাপাড়ার নলসোন্দা গ্রামের নুরুল ইসলাম প্রামাণিক গং নলসোন্দা মৌজার জমির আদালতের ডিগ্রী নম্বর (৪২২/৮৩) ব্যবহার করে খাদুলী মৌজার ৫৪ শতক জমি দখল করার চেষ্টা করছে। দরিদ্র নরেশ চন্দ্র সরকার ডিগ্রী অন্য ব্যক্তির আর ৫৪ শতক নিজ নামীয় জমির সকল সঠিক কাগজপত্রসহ সৈয়দ আলীর বিরুদ্ধে উল্লাপাড়া সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। (মামলা নং-২৪৫/৯)। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জাহিদ হোসেন জানান, আদালতে বিবাদী প্রমথ চৌধুরী স্বাক্ষরিত যে সোলেনামা জমা দিয়েছে তা সম্পূর্ণ জাল। ১৯৭৮ সালে প্রমথ চৌধুরী স্বাক্ষরিত সোলেনামা দেয়া হয়েছে অথচ প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ মারা গেছেন। আদালত দুটি মামলার মধ্যে একটি সরকারের পক্ষে স্থিতাবস্থা জারি করেছে। এ বিষয়ে সৈয়দ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদটি প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। রাজাকার পুত্র সৈয়দ আলীর এ সমস্ত জালিয়াতি প্রকাশ পাওয়ায় এলাকার মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এলাকাবাসী অবিলম্বে ভূমিদস্যুর কবল থেকে প্রমথ চৌধুরীসহ অন্যান্য জমি উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন।
×