ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে হালখাতা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে হালখাতা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কেরানীগঞ্জ, ১৩ এপ্রিল ॥ লালসালু কাপড়ে বাঁধাই করা টালিখাতার পরিবর্তে প্রচলন হয়েছে ফাইল এবং পহেলা বৈশাখ বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীরা গণনা করছেন পহেলা জানুয়ারি। দোকানে ক্যাশ বাক্সের ওপর এখন আর চোখ পড়ে না লালখাতা। কালের বিবর্তনে এভাবেই পরিবর্তন হয়েছে বাঙালী জাতির ব্যবসায় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী হালখাতা। শহরে ব্যবসায়ীদের মতে, বাঙালী ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্য হালখাতা হারিয়ে গেছে। সেই লালসালু কাপড় দিয়ে বাঁধাই করা ৩৬০ পৃষ্ঠার টালিখাতা এখন ব্যবসায়ীরা সংরক্ষণ করছে না। ওই খাতার পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফাইল আর ব্যাংকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেলদেন করতে বেছে নেয়া হচ্ছে পহেলা জানুয়ারিতে। রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। নববর্ষকে বরণ করতে সর্বত্র চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে হৈচৈ নেই হালখাতা নিয়ে। মফস্বলের কিছু হাটবাজার ও মোকামে হালখাতার প্রস্তুতি দেখা গেলেও আধুনিক শহরে এর কোন রেশ নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে হালখাতার দাওয়াত পৌঁছেছে দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে। বিনিময়ে দেশ থেকে হালখাতার আমন্ত্রণ যাচ্ছে না সেখানে। তারা আরও বলেন, পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা হালখাতা খুলে পুরনো দিনের বকেয়া চুকিয়ে নতুন হিসাব শুরু করতেন। কিন্তু আসন্ন পহেলা বৈশাখে বকেয়া টাকা পরিশোধ হবে এমন আশা করছে না ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকা ঘুরে দেখা গেছে কিছু কিছু ব্যবসায় কেন্দ্রে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। বিশেষ করে তাঁতীবাজার স্বর্ণের অধিকাংশ দোকানে তুলির রঙে নতুন সাজে সাজানো হচ্ছে। কিছু প্রস্তুতি রয়েছে ইসলামপুর কাপড়ের মার্কেটেও। স্বর্ণের মার্কেট থেকে তাদের নিয়মিত ক্রেতা ও বিক্রেতাদের শুভেচ্ছা কার্ডের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে পহেলা বৈশাখের আমন্ত্রণ। তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীরা সে রকম প্রস্তুতি গ্রহণ না করলেও বছরে একবার ধোয়ামোছার কাজটি বাদ দিতে চাচ্ছেন না। সেই তাগিদ থেকেই চলছে রং দেয়া ও ধোয়ামোছার কাজ। ইসলামপুর কাপড়ের মার্কেটের হিরা টেক্সটাইলের মালিক শাহ জাহান বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের লেনদেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন। এর জন্য নতুন হিসাব খোলা ও পুরনো হিসাব বন্ধ করে দেয়া সব করা হচ্ছে পহেলা জানুয়ারিকে সামনে রেখে। চকবাজারের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন বলেন, তার ব্যবসা ভারতের সঙ্গে। পহেলা বৈশাখে হালখাতা উপলক্ষে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টেলিফোনে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ভারতের ব্যবসায়ীরা হালখাতা এখনও পালন করছেন। কিন্তু দেশ থেকে চর্চার অভাবে হালখাতার রেওয়াজ উঠে যাচ্ছে। তার মতে, পূর্বপুরুষরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে লাল কাপড়ের টালিখাতা ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরা টালির পরিবর্তে প্রচলন শুরু করছেন ফাইল। তবে মফস্বলের মোকাম, হাটবাজার ও আড়তে প্রস্তুতি চলছে। তারা ওইদিন ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জনাবেন দোকানে। ক্রেতা সকালে এসে পুরনো পাওনা পরিশোধ করে নতুনভাবে হিসাব খুলবেন। একই সঙ্গে দোকানির পক্ষ থেকে ক্রেতাকে মিষ্টিমুখ করানো হবে। জানা গেছে, দিল্লীর অধিশ্বর সম্রাট আকবর ষোল শতকে বাংলা সনের প্রচলনের পর খাজনা আদায়ের দিন ধার্য করেন পহেলা বৈশাখ। অনুরূপভাবে ব্যবসায়ীরা পুরানো খাতা বাতিল করে নতুন খাতা শুরু করে ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কাছে এটি ছিল উৎসব। ঐতিহ্যবাহী এ হালখাতার উৎসব পহেলা বৈশাখে পালন করা হয়। সতেরো থেকে আঠারো শতকের দিকে এই হালখাতার প্রচলন শুরু হয়। হালখাতা উপলক্ষে দোকানের বেচাকেনা বন্ধ রেখে ক্রেতাদের সঙ্গে মিলনমেলার উৎসবে মেতে উঠতেন মহাজন বা বিক্রেতারা। ১৯ শতকের দিকে ঢাকার ইসলামপুরে পহেলা বৈশাখে হালকাতা উৎসব পালন করা হতো।
×