ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৮৩ ভাগ পরিবার ব্যবহার করে টিউবওয়েলের পানি

দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

 দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল

আনোয়ার রোজেন ॥ অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ দিন দিন বাড়ছে। সুপেয় পানির উৎস হিসেবে দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দেশের ৮৩ শতাংশ পরিবার এককভাবে টিউবওয়েল বা নলকূপের পানি ব্যবহার করে। বিপরীতে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের উৎস হিসেবে পুকুর, নদী-নালা এবং বৃষ্টির পানির ব্যবহার খুবই কম। সারাদেশে মাত্র ১ শতাংশ পরিবার সম্মিলিতভাবে এ তিনটি উৎসের পানির ব্যবহার করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এ সংক্রান্ত সর্বশেষ জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপর চাপ অব্যাহত থাকলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও ব্যাপক মাত্রায় আর্সেনিক দূষণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে বৃষ্টি এবং ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির ব্যবহার বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে বিশুদ্ধ পানির সংস্থান নিয়ে শঙ্কা বাড়বে। বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্টাটিসটিকস-২০১৬ এর তথ্য মতে, পরিবারে পানির উৎস হিসেবে ট্যাপ ও নলকূপের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। ২০১৩ সালে এ দুটি উৎসের ব্যবহার ছিল ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারে। ২০১৬ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ শতাংশে। মাঝের বছরগুলোতেও ধারাবাহিকভাবে এটি বেড়েছে। ২০১৪ সালে ট্যাপ ও নলকূপ ব্যবহার হতো ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারে, ২০১৫ সালে সেটি বেড়ে হয় ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ। নলকূপের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার রংপুরে, কম বরিশালে ॥ জরিপ মতে, সারাদেশে মোট ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার এককভাবে নলকূপের পানির ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে শহরের ৭২ শতাংশ পরিবার এবং গ্রামের ৯৩ শতাংশ পরিবারের পানির প্রধান উৎস নলকূপ। এছাড়া নলকূপের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে, ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে খুলনা বিভাগ, ৯০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ, ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার নলকূপ ব্যবহার করে। এছাড়া বরিশালে নলকূপ সব চেয়ে কম ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার নলকূপ ব্যবহার করে। এ প্রসঙ্গে জরিপটি পরিচালনার জন্য বাস্তবায়িত মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্টাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) প্রকল্পের পরিচালক একেএম আশরাফুল হক বলেন, সারাদেশের ২ হাজার ১২টি নমুনা এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দ্বৈত পদ্ধতিতে দুটি পৃথক তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এতে জরিপের ফলাফল ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। পুকুর, নদী ও বৃষ্টির পানি ব্যবহারকারী পরিবার মাত্র ১ শতাংশ ॥ জরিপ মতে, সারাদেশে পুকুরের পানি ব্যবহার করে মোট শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার। গ্রামের মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবারের পানির উৎস হচ্ছে পুকুর। সবচেয়ে বেশি পুকুরের পানি ব্যবহার হয় খুলনা বিভাগে ৩ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারে। দেশে মোট শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পরিবার নদী বা নালার পানি ব্যবহার করছে। এর মধ্যে গ্রামের শূন্য দশমিক ২ শতাংশ এবং শহরের শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পরিবার নদী বা নালার পানি ব্যবহার পানি ব্যবহার করে। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারে নদী ও নালার পানি ব্যবহার করে। এখনও কুয়ার পানি ব্যবহার করে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে শহরে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ এবং গ্রামে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারের পানির উৎস কুয়া। সবচেয়ে বেশি কুয়ার পানি ব্যবহার হয় সিলেট বিভাগে ২ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম কুয়া ব্যবহার হচ্ছে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। দেশে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার গ্রামের আর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার শহরের। খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার বৃষ্টির পানির ব্যবহার করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরিপ থেকে এটা স্পষ্ট দেশে বৃষ্টির পানি দীর্ঘদিন সংরক্ষণের উদ্যোগ এখনও তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। এ ব্যাপারে সরকার-বেসরকারী যতটুকু প্রচার প্রচারণা আছে তা যথেষ্ট নয়। এদিকে ভূগর্ভ থেকে নির্বিচারে পানি উত্তোলনের ফলে প্রতিবছর কেবল ঢাকায় পানির স্তর তিন ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে তারা বিকল্প প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো ও দূষণ প্রতিরোধের পরামর্শ দিচ্ছেন। সুপেয় পানির সহজলভ্য উৎসবঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের জন্য কাজ করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, এমনিতে বিশ্বজুড়েই সুপয়ে পানির সঙ্কট আছে। আমাদের সঙ্কট আরও গভীর। কারণ আমাদের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের উৎসগুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার। তাই সবার আগে দূষণ রোধ করতে হবে। একইসঙ্গে জোর দিতে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার ওপর। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী বলেন, শিল্পায়ন, গৃহস্থালি ও কৃষিভিত্তিক উৎসগুলো থেকে ব্যাপক মাত্রায় নির্গত দূষণের ফলে সৃষ্ট পানি স্বল্পতা মোকাবেলায় প্রকৃতি নির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করা উচিত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পরীক্ষিত কিছু উদ্যোগ রয়েছে যা একই সঙ্গে পরিবেশ উপযোগী এবং কৃত্রিম সংরক্ষণাগারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী পানির সংস্থান করে। অধ্যাপক আশরাফ আলী আরও বলেন, সমস্যা সমাধানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন ও যান্ত্রিক প্রকৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে নদীকে কেবল পানির প্রবাহ হিসেবে দেখা হয়। অথচ নদীকে জীবন্ত সত্তা অথবা সমগ্র প্রকৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। পাশপাশি গ্রীন ইকো রুফ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও রিচার্জ, গ্রীন স্ট্রিট, বাওরিটেনশন এ্যান্ড ইনফিলট্রেশন, ড্রেনেজ সিস্টেম ইত্যাদি প্রকৃতি নির্ভর সমাধানের ওপর গবেষণা এবং ব্যাপক প্রচার হওয়া প্রয়োজন।
×