ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সম্ভাবনাময় আগামীর প্রত্যাশায় চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৪ এপ্রিল ২০১৮

সম্ভাবনাময় আগামীর প্রত্যাশায় চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন

মনোয়ার হোসেন ॥ ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো/একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো ...। সেই আলোর পথরেখায় বিদায় নিল আরেকটি বছর। সম্ভাবনাময় আগামীর প্রত্যাশায় সময়ের স্রোতধারায় বিলীন হলো বঙ্গাব্দ ১৪২৪। শুক্রবার ছিল বিদায়ী বাংলা বছরের শেষ দিন ত্রিশে চৈত্র। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সংস্কৃতির রীতিমাফিক চৈত্রসংক্রান্তি। এক সময়ের গ্রামীণ এই লোকাচার এখন মিশে গেছে নাগরিক জীবনে। তাই তো শহর ঢাকায় বসন্তের শেষ দিনটি হয়ে উঠলো বর্ণময়। মঙ্গল প্রদীপের আলোয় পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে স্বাগত জানানো হলো নতুন বছরকে। লাঠিয়ালের লাঠিখেলায় শিল্পকলার আঙিনা উঠলো এক খন্ড গ্রামবাংলা। কোথাও বা কবিতার শব্দমালায় উচ্চারিত হলো সম্প্রীতির বারতা। গানের সুরে সুরে আলিঙ্গন করা হয়েছে শিকড়কে। ছন্দোময় নৃত্যের তালে বছরের শেষ দিনটিতে ব্যক্ত হয়েছে অসুরবিনাশী সুরের বারতা। এভাবেই মানবিকতার মর্মবাণীতে শান্তির প্রত্যাশায় ধাবিত হয়েছে নাগরিক মন। চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে নগর জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে অনুষ্ঠান। শেকড়সন্ধানী শহরবাসী ঐতিহ্যের আবাহনে সামিল হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপনের সেসব আয়োজনে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে যৌথভাবে চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজন করে সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে চৈত্র সংক্রান্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। বাংলা বছরের শেষ দিনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসেছিল লোকগানের আসর। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত ময়দানে ছিল লাঠিখেলাসহ লোকগান ও নৃত্য পরিবেশনা। লালমাটিয়ার বেঙ্গল বইয়ের উঠানে ছিল জলের গানের পরিবেশনা। লাঠিখেলা ও লোকগানের পরিবেশনা ॥ দুপুর গড়ানো বিকেলে ঢোলের বোলে সরগরম হয়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত আঙিনা। বাদ্য-বাজনার তালে তালে চলতে থাকে লাঠিখেলা। মাঠের চারপাশ ঘিরে থাকা দর্শক যেন ফিরে যায় তার চিরচেনা গ্রামীণ জীবনে। লাঠিখেলার মনমাতানো নানা কসরত প্রদর্শন করে কিশোরগঞ্জের বৌলাই জমিদারবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী লাঠিয়াল দল। দলনেতা ওসমান গনির নেতৃত্বে ১১ সদস্যের দলটি ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরিয়ে যায় লাঠি। প্রতিপক্ষকে আক্রমণের সঙ্গে উপস্থাপিত হয় আত্মরক্ষার নৈপুণ্যময় কৌশল। এরপর বিকেল গড়ানো সন্ধ্যায় শুরু হয় বিচিত্র আঙ্গিকের লোকগানের পরিবেশনা। গীত হয় গম্ভীরা, পালাগানসহ ফকির লালন সাঁই, হাছন রাজা, বিজয় সরকার, কালুশা ফকিরের মতো লোকবিদের গান। দিতি সরকার গেয়ে শোনান ‘আমার মুর্শিদ পরশমণি গো’। শান্তা তুলি পাল গেয়েছেন ‘তুমি জানো না গো প্রিয়/তুমি মোর জীবনের সাধনা’। উতলা সুরে রিতা ম-ল শুনিয়েছেন ‘তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে/তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে’। ডলি মন্ডলের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘মিলন হবে কতো দিনে’। ‘নদী ভাঙ্গা ঢেউ বোঝে না কেউ’ শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন ভবা পাগলা। গোলাম মোস্তফার গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘বাউলা কে বানাইলো রে’। বিদ্যুত কুমার গেয়েছেন ‘ডাকলে কি আর প্রাণ জুড়াবে গো’। আট শিল্পীর সম্মিলিত প্রয়াসে পরিবেশিত হয় রসকস শীর্ষক গম্ভীরা গান। এগারো শিল্পীর কণ্ঠ আশ্রিত পালাগানে উপস্থাপিত হয় পদ্মার নাচন শীর্ষক পরিবেশনা। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চৈত্রসংক্রান্তি ॥ প্রতিবছরের মতো এবারও বর্ণিল আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তি উদ্যাপন করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত আয়োজনটির সূচনা হয় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে। এসময় উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মামুনুর রশীদসহ ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ। শিল্পকলা সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত আয়োজনে সবার মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া হয় মুড়ি-মুড়কি বিতরণের মাধমে। সেই সঙ্গে ছিল নৃত্য-গীত কবিতায় সজ্জিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সাংস্কৃতিক পর্ব শুরু হয় শাহদাৎ হোসেন খানের নেতৃত্বে সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘ঢোল বাজে ঢোল বাজে বাংলাদেশের ঢোল’, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’, ‘হাওরা মাঝির নাও’, ‘সোনার বান্দাইলা নাও’ গানের সুরে পরিবেশিত হয় সম্মেলক নৃত্য। অনুষ্ঠানে দ্বৈত নৃত্য পরিবেশন করেন রবিন ও লিটা, মাসুক ও লতা এবং জিয়া ও সান্তনা জুটি। সঙ্গীত পরিবেশন করেন চারুনীড়ম থিয়েটারের সদস্যরা। নাটকের গান শুনিয়েছেন সুবচন নাট্য সংসদের শিল্পীরা। কোরিওগ্রাফি উপস্থাপন করে প্রাচ্যনাটের সদস্যরা। নাট্যাংশ উপস্থাপন করে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের শিল্পীরা। সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের আয়োজন ॥ রাজধানীর চৈত্রসংক্রান্তির আরেক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যৌথভাবে বর্ষবিদায়ের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি সুরের ধারার শিল্পীরা পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের গান। সঙ্গে ছিল নৃত্য পরিবেশনা ও কবিতার শিল্পিত উচ্চারণের আবৃত্তি। চৈত্রসংক্রান্তি কথনে অংশ নেন সুরের ধারার চেয়ারম্যান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। বাংলা একাডেমির আয়োজন ॥ চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে শুক্রবার থেকে শুরু হলো বাংলা একাডেমি পরিচালিত পাঁচ দিনব্যাপী ফোকলোর সামার স্কুলের পঞ্চম বার্ষিক কর্মশালা। এবারের সামার স্কুলের মূল প্রতিপাদ্য এথনো মিউজোকলজি। এই সামার স্কুলের ২০ প্রশিক্ষণার্থীকে যুক্তরাজ্যের জেনিফার রিড, ভারতের ড. সুখবিলাশ বর্মা, ড. শেখ মকবুল ইসলাম, ড. অসীমানন্দ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক জওহরলাল হান্ডুসহ বাংলাদেশের বিশিষ্ট ফোকলোরবিদগণ ফোকলোর বিষয়ে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক ধারণা প্রদান করবেন।
×