ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হালখাতার উৎসবের অপেক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৩ এপ্রিল ২০১৮

হালখাতার উৎসবের অপেক্ষা

অনন্যা রহমান সৃষ্টি ॥ নববর্ষের প্রথমদিনে ব্যবসায়ীদের হাল খাতা উদযাপন একটি পুরনো রীতি। এর উদ্দেশ্য হলো গেল বছরের দেনা পাওনা মিটিয়ে একটি নতুন বছরের হিসাব নিকাশের হালখাতা খোলা। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে এবারও বিশেষ এই খাতা তৈরি আর বেচা কেনার ধুম পড়েছে পুরান ঢাকার সৈয়দ হাসান আলী খান লেন বাবু বাজার রোডে। অলি-গলিতে সারি সারি বাসার ভিতর চলছে কারখানার শ্রমিকদের তুমুল তোরজোর আর উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে হালখাতা বনানোর কাজ। এমন একটি কারখানার নাম ইউসুফ এ্যান্ড কল। এখানেই তৈরি হয় শুধুই খাতা, তাও যে সে খাতা নয়, বাণিজ্যের হাল ধরবে যে খাতা সেই হালখাতা। কারখানার এক কর্মচারী কাদের হোসেন বলেন, নববর্ষের হাল খাতা হিসেবে পরিচিত ট্যালি খাতা এক থেকে দেড় মাস আগে বানানো শুরু হয়। সাড়ে তেরো ইঞ্চি লম্বা আর পৌনে তেরো ইঞ্চি পাশে এই ট্যালি খাতা তৈরি হয়। বৈশাখের লাল সাদা প্রতীক হিসেবে এই ট্যালি খাতা লাল শালু দিয়ে মোরানো হয়ে থাকে। বারো মাস চলে এই খাতা। কিন্তু বৈশাখের সময় বেচা কেনা বেশি ভাল থাকে। তিনি বলেন, দিস্তা হিসেবে খাতাগুলো বিক্রি হয়। ১৫ শিটের খাতার দাম ৫০ টাকা এবং ১০ দিস্তা খাতার দাম ৫০০ টাকা। এছাড়া জাবেদা খাতার দিস্তা ১৩০ টাকা, হাত ছিতা খাতা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা এবং ট্যালি খাতা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আমরা দশ-বারো জন মিলে কাজ করি কারখানাতে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। হালখাতা এখন আগের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়। লাল শালু ট্যালি খাতার মধ্যে সাদা রোল টানা খাতাই বেশি চলে এবং যত হিসাব নিকাশ সব ট্যালি খাতার মধ্যে হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় খুব কম হলেও অনেকেই দুই দিন হালখাতা পালন করছেন। সরকারী বর্ষপুঞ্জির পহেলা বৈশাখে ক্রেতার মনোরঞ্জনের জন্য, আর লোকনাথ পুঞ্জিকার দিন গনেশ দেবতার মানভঞ্জন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে দীপ জুয়েলার্সে মালিক সুমন ঘোষ বলেন, বৈশাখের শুরুটা হয় আমাদের গণেশ পূজা দিয়ে। আর এর মধ্য দিয়েই আমাদের বছরটা যেমন শুরু হয়, তেমনি শুরু হয় ব্যবসারও। তিনি বলেন, আমরা আমাদের পুরনো ধারাটা এখনও বজায় রেখেছি। এখনও আমরা সবাইকে আমন্ত্রণ করি, যারা আসার আসেন তাদের জন্য আমরা মিষ্টি, ঠা-া পানীয় এসবের আয়োজন করি। পহেলা বৈশাখের পুরান ঢাকার যে ঐতিহ্য সেটি আমরা এখনও ধরে রেখেছি। বর্ষবরণের প্রথমদিনে আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করব এবং পরের দিন আমরা পূজা অর্চনার যে আনুষ্ঠানিকতা আছে সেটি আমরা পালন করব। হালখাতা এখন আগের মতোই জনপ্রিয় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাপ দাদার আমলে পুরনো যে রীতিটা ছিল তা পালন করছি। তবে হালখাতরা যে রেওয়াজ অতীতে ছিল পুরনো ও নতুন ক্রেতাদের আমন্ত্রণ করে আনা, মিষ্টি খাওয়া বা তাদের সঙ্গে হইহুল্লা করা এবং পুরনো হিসাব চুকিয়ে আবার নতুন করে লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি করা, এই জিনিসটা এখন আর আগের মতন নেই। নেই বলতে এখন আসে না। আমন্ত্রণ জানালে তারা এড়িয়ে যান। কারণ টাকা দিতে হবে। তিনি বলেন, আগে একটা সময় ছিল আমরা বাড়ি বাড়ি কার্ড নিয়ে আমন্ত্রণ জানাতাম বৈশাখী উপলক্ষে। এখন সব কিছু অনেক সহজ হয়ে গেছে। এখন ক্রেতাদের মোবাইল নম্বর আগে থেকেই আমাদের কাছে থাকে, তাই খুব সহজেই মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকি। বৈশাখকে ঘিরে এবার কেমন প্রস্তুতি চলছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁতিবাজারের দি আলো জুয়েলার্সের মালিক পাপ্পু ঘোষ বলেন, চৈত্র মাসজুড়েই আমাদের পুরো প্রস্তুতি চলছে ওই দিনটাতে আমরা কি কি করব। ওই দিন আমরা দোকান খুলি সকাল সাড়ে ১০টায় এবং সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি উৎসবমুখর, এখন মানুষ একটা উৎসব পেলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। এখন সবাই আনন্দ করতে চাই, আনন্দটা একসঙ্গে মিলে মিশে করে একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। আগের থেকে রেসপন্স কেমন এবং ভবিষ্যতে উৎসব ভাব আরও বাড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের থেকে রেসপন্স অনেক বেশি, আর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আমার মনে হয়। মূলত বৈশাখের দিন আমরা চাই আমাদের যে পুরনো গ্রাহকরা আছেন, যাদের সঙ্গে আমরা সারা বছর লেনদেন করি, তাদের একটু আপ্যায়ন করতে। এই বৈশাখেই আমরা সুযোগ পাই সম্পর্কটা আরও কিভাবে দৃঢ় করা যায়। মূলত সেই চেষ্টাই থাকে আমাদের। সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই আমরা তারপর যারা আসে তাদের জন্য কিছু বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা রাখি। পুরনো কোন লেনদেন থাকলে তারাও পরিশোধ করার চেষ্টা করে। বর্তমানে হালখাতার খাবারের আয়োজনে মিষ্টির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আরও অনেক মুখরোচক খাবার। পায়েস, সিঙ্গারা, সামুচা, কোমল পানীয় থেকে শুরু করে অনেকে বিরিয়ানী, খিচুড়ির ব্যবস্থাও করে থাকেন বর্ষবরণে। এই উৎসবটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এদিনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বাংলা বছরের প্রথম দিনকে স্বাগতম জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সব অশুভ শক্তিকে পিছনে ফেলে নতুন দিনের শুভ সূচনা হোক এটাই সবার একমাত্র আশা থাকে।
×