ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলা নববর্ষ ॥ প্রাণের উৎসব

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১৩ এপ্রিল ২০১৮

বাংলা নববর্ষ ॥ প্রাণের উৎসব

বছর ঘুরে আবার চলে এলো বাংলা নববর্ষ। উৎসবে-আনন্দে প্রতিবছর এই দিনকে বরণ করে নেই আমরা বাঙালীরা। আর আমাদের বাংলাদেশে এই দিনটি সরকারী ছুটির দিন। পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালীর সার্বজনীন প্রাণের উৎসব। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। নতুন আলোয় উদ্ভাসিত একটি নির্মল সকাল, একটি উজ্জ্বল দিনের প্রতীক্ষায় থাকে গোটা বাঙালী জাতি। বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিকথা আমাদের দেশে প্রচলিত বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন মূলত হিজরী সনেরই একটি রূপ। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চান্দ্র বছরে ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। চাষাবাদ এবং এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য মোগল স¤্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর তার দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবার এ হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে, তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১ বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ ধরা হয়। বাংলা নববর্ষ উৎসবের সূচনা বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত সম্রাট আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য জমিদারের খাজনা পরিশোধ করত। নববর্ষের প্রথম দিন জমিদারগণ তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হতে থাকে। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। তৎকালীন রাজ পুণ্যাহই বর্তমানের ‘হালখাতা’ বা ‘গদিসাইত’। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পুণ্যাহ উৎসব নববর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং এরপর থেকে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান চলতে থাকে। ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে পুণ্যাহ উৎসবও হারিয়ে যায়। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন গ্রহীতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত আচার-অনুষ্ঠানের এই রেওয়াজের প্রচলন আজও রয়েছে দেশের সর্বত্র। গ্রাম-বাংলার বৈশাখী উৎসব বাংলার গ্রামে বৈশাখী উৎসব চলে বেশ কয়েকদিন। আর এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে বৈশাখী মেলা। কী আছে ঐ মেলায়? নানা ধরনের গানের আসর বসে সেখানে। আসরে গান গাইতে নানা গ্রাম থেকে আসে কত গায়ক, বাউল আর নাচের দল। আসে যাত্রাপালার অভিনয়শিল্পীরা। গায়কের দল পরিবেশন করে নানা ধরনের গান। যেমন- পালাগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, কবি গান, বাউল গান, মুর্শিদী, মারফতি, ভাটিয়ালী আরও কত ধরনের গান। অভিনয়শিল্পীরা পরিবেশন করেন যাত্রাপালা। লাইলী মজনুর পালা, ইউসুফ জুলেখার পালা, রাধা কৃষ্ণের পালার আসর দেখে গ্রামের মানুষ কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয়। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ আসর চলে। সবকিছু ছাড়িয়ে সবার মূল আকর্ষণ ও আগ্রহ থাকে পুতুলনাচ আর নাগরদোলায়। এছাড়াও মেলায় পাওয়া যায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার পিঠাপুলি, মণ্ডা-মিঠাই, বিভিন্ন ধরনের আচার ও হাতে তৈরি চিত্রকর্ম, খেলনা, মাটির পুতুল, জামা কাপড়, বাহারি খেলনা ইত্যাদি। হারিয়ে যাওয়া সেই উৎসবগুলোর মধ্যে আছে- খাজনা আদায়ের বার্ষিক উৎসব- পুণ্যাহ, ঘুড়ি উৎসব, ঘোড়াদৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, নৌকাবাইচ আরও কত কিছু। শহুরে বৈশাখী উৎসব বাংলাদেশে সবচাইতে বর্ণিল বৈশাখী উৎসব উদযাপিত হয় ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। ভোর হতেই হাজার হাজার নানাবয়সী মানুষ জমা হয় ঢাকায় রমনার বটমূলে ও চট্টগ্রামে ডিসি হিলের পাদদেশে। ছায়ানটের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি গেয়ে নতুন বছরের নতুন দিনকে বরণ করে নেন। এছাড়াও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। ঢাকার মেলাতেও মূল আকর্ষণ থাকে ঐ নাগরদোলাই। সববয়সী মানুষই খুব আগ্রহ নিয়ে নাগরদোলায় চড়ে। নব্বইয়ের দশক থেকে বৈশাখে গ্রামের হালখাতার হাওয়া ছড়াতে থাকে শহরে, জড়াতে থাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। লোকজ মেলা রূপ নেয় জাতীয় উৎসবে। ফলে পহেলা বৈশাখ লোকজ উৎসবের গণ্ডি পেরিয়ে জড়িয়ে গেছে করপোরেট দুনিয়ার সঙ্গেও। একসময় বৈশাখী মেলায় থাকত শুধু মাটির পুতুল, মুড়ি-মুড়কি, খই, বাতাসা, মাটির ফুলদানি, বাঁশের মগ, বেত বা কাঠের কারুকার্য করা আয়না, কাঁসা-পিতলের শোপিস, তালপাতা কিংবা সাদা কাপড়ে হাতের কারুকার্যময় হাতপাখা, চড়কি আর মুখোশ। বৈশাখী উৎসব আজ আর সেখানে আটকে নেই। পণ্য উৎপাদন, বিপণন আর প্রসারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ পরিকল্পনা যোগ হয়েছে বৈশাখকে ঘিরে। দেশী ফ্যাশন, দেশী খাবার, হ্যান্ডিক্র্যাফটস আর হাতে তৈরি খেলনার শিল্পগুলো সারা বছরই থাকে বৈশাখের অপেক্ষায়। আদিবাসীদের বৈসাবি উৎসব বৈসাবি বাংলাদেশে তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা। আদিবাসীরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলো বৈসাবি নামে পরিচিত। সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়। ত্রিপুরাদের বৈসাবি উৎসব ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। বৈসু উৎসবে একটানা তিন দিন হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু নামে পালন করা হয়। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। এই দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা বসতবাড়ি, কাপড় চোপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে । ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। গবাদিপশুদের গোসল করানো হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণ-তরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে। এদিন মহিলারা বিন্নি চালের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। পুরুষেরা বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় মেতে উঠে। হারি বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে নববর্ষকে স্বাগত জানায়, ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। সবাই গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন, সেমাই ও মিষ্টি খায়। এছাড়া এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণী বধ করে না। অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন বিসিকাতালে আমিষ খাবার গ্রহণে বাধা নেই। এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। কেউ যেন না খেয়ে ফিরে না যায় সেজন্য সারাদিন ঘরের দরজা খোলা থাকে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে ত্রিপুরারা মনে করে। মারমাদের বৈসাবি উৎসব মারমারা পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে সাংগ্রাই উৎসব বলে। তারা বৈশাখের প্রথম দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা জনগোষ্ঠী। সবাই নতুন পোশাক পরে একে অপরের বাড়ি যায় এবং কুশল বিনিময় করে। সব বয়সের নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে ওঠে। মারমা বৃদ্ধরা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়। এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও স্নান করে এবং নতুন পোশাক পরিধান করে। বয়স্করা মন্দিরে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়। মারমা জনগোষ্ঠীর এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসব। গান বা সঙ্গীতের মূর্ছনার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীর দল একে অন্যের গায়ে পানি ছিটিয়ে আনন্দ উপভোগ করে। তাদের বিশ্বাস এই জল ছিটিয়ে দিলে তাদের মনের সব পাপ-পঙ্কিলতা দূর হয়ে যায়। মারমা ভাষায় জল অনুষ্ঠানকে বলা হয় রিলংপোয়ে। চাকমাদের বৈসাবি উৎসব চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব হলো বিজু। এরা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে। ফুল বিজুর দিন গভীর অরণ্য থেকে ফুল সংগ্রহ করে চারভাগে ভাগ করে একভাগ ফুল ও নিমপাতায় ঘরবাড়ি সাজায়, দ্বিতীয় ভাগ ফুল বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশে উৎসর্গ করে প্রার্থনা করে ও ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে, তৃতীয় ভাগ ফুল নদী, খাল বা পুকুরের পাড়ে তৈরি পূজাম-পে রেখে প্রার্থনা করে এবং চতুর্থভাগ ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। মূল বিজুর দিনে অসংখ্য কাঁচা তরকারি সংমিশ্রণে পাচন বা ঘণ্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা তৈরি করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিন্নি ধানের খই, নাড়ু, সেমাই ও পাহাড়ি মদও থাকে। এই দিনে চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র‌্যালিতে যোগ দেয়। সন্ধ্যায় সবাই বৌদ্ধবিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়, ভিক্ষু সংঘের ধর্মোপদেশ শুনে এবং বিশেষভাবে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে বৈশাখী উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আর চিরকালীন বাংলাকে নানা ভাস্কর্য আর ছবি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। এখানে সববয়সী মানুষই অংশ নেন। রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি বানানো হয় এই শোভাযাত্রার জন্য। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের একটি অন্যতম আকর্ষণ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ একটি সাংস্কৃতিক মিছিল বা শোভাযাত্রা বিরল ঘটনা হিসেবে সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই শোভাযাত্রায় নয়নাভিরাম পোশাকের সমাহার, চিত্রাঙ্কনের উৎকর্ষ, চারুকলার অসামান্য রচনাশৈলী সমগ্র বিশ্বে বিরল ঘটনা। এটি শুধু একটি শোভাযাত্রা নয়, বাংলার ঐতিহ্য ও শিল্পকলার পারদর্শিতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের প্রচণ্ড অনুরাগ সবই প্রকাশ পেয়েছে এই শোভাযাত্রার মধ্যে। নববর্ষের এই শোভাযাত্রা যে শুধু বাংলার গ্রাম ও শহরের চিত্রকে তুলে ধরেছে তা-ই নয়, বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনের প্রতিচ্ছবিকে তুলির আঁচড়ে অবয়বের অবকাঠামোর মাঝে অপরূপভাবে দৃশ্যমান করে তোলে প্রতিবছর এই ১ বৈশাখের প্রথম প্রহরে। ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নবেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা বা ইনট্যানজিবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙালী জাতিসত্তার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বছরের প্রথম দিনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ মাধ্যমে অপশক্তির অবসান এবং বাংলাদেশের মানুষ কল্যাণময় ভবিষ্যতের আশা ব্যক্ত করে চলেছে। প্রাচীন আরবে ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামক যে দুটি উৎসব ছিল, এর প্রথমটি ছিল সন কেন্দ্রিক। ভারতীয় উপ-মহাদেশ দীর্ঘদিন মোগল শাসনাধীনে থাকায় সেখানেও নওরোজ উৎসব উদযাপিত হতো। কিন্তু বাংলা সন প্রবর্তনের পর নওরোজ উৎসবের স্থলে স্থান করে নিয়েছে পহেলা বৈশাখের উৎসব। পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনের এক বিশেষ দিন। পুরনো বছরের যত না পাওয়া, হতাশা, দুঃখ আর ক্ষোভ, সব আমরা ভুলে যাই। আর শুরু হয় এক নতুন বছরের, যেই বছরে আমরা নতুন নতুন সব আশা আর স্বপ্নে বুক বাঁধি। আর এমনি সব নতুন স্বপ্ন আর নতুন আশা দিয়েই তো এগিয়ে যায় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। কালক্রমে বাংলা সন কেন্দ্রিক এই উৎসব বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সার্বজনীন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক Email: [email protected]
×