ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিশ্চুপ

মুন্নু স্টাফলারের দরবৃদ্ধির নেপথ্যে কারসাজি

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১২ এপ্রিল ২০১৮

মুন্নু স্টাফলারের দরবৃদ্ধির নেপথ্যে কারসাজি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বর্তমানে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে লোভনীয় শেয়ারের নাম মুন্নু জুট স্টাফলারর্স। কারণ গত ২৯ মার্চের পর থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৯ কার্যদিবসই শেয়ারটির সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে গত ৯ এপ্রিল কোম্পানিটির শুধু একদিন বিক্রেতা ছিল। ওইদিনই শেয়ারটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৫৫ হাজার ৬শ’ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। তবুও শেয়ারটির আগের দিনের চেয়ে প্রায় সর্বোচ্চ দরবৃদ্ধির কাছাকাছি দর বেড়েছিল। বিনিয়োগকারীদের এই শেয়ারের আগ্রহের নেপথ্যে রয়েছে কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজের অস্বাভাবিক ক্রয়াদেশ এবং শেয়ার কেনার চাহিদা। নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, মুন্নু গ্রুপের আরও একটি শেয়ার মুন্নু সিরামিকের দর ৪২ থেকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৬২ টাকায় উঠানোর ক্ষেত্রেও এক হাউসটির হাত রয়েছে। দুটি শেয়ারের দরবৃদ্ধির পেছনে ক্রীড়ানকের ভূমিকা ছিল এই কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ। গত ৯ এপ্রিল মুন্নু স্টাফলারের সর্বোচ্চ লেনদেনের দিনে কমার্স ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফলিওতে শেয়ারটির ৯ হাজার শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে একই দিনে স্টাফলারের প্রায় ১৭ হাজার শেয়ার কেনা হয়। এই কোম্পানিটির সাম্প্রতিক দরবৃদ্ধির পেছনে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ নামের আরও একটি ব্রোকারেজ হাউসের নাম রয়েছে। সেখান থেকেও একদিনে প্রায় ৯ হাজার শেয়ার কেনা হয়েছিল। পরবর্তীতে একক ক্রেতার ভূমিকায় দেখা গেছে গ্লোব সিকিউরিটিজকে। কমার্সের পাশাপাশি এই দুটি ব্রোকারেজ হাউসেই ক্রেতার ভূমিকা থাকতে বেশি দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪৬ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনী এই কোম্পানিটির অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির পেছনে ছিল রাইট শেয়ার ছাড়ার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই এই হাউসগুলোর কর্মকর্তারা আগেই এই তথ্য জেনে যান। ফলে লোভনীয় এই শেয়ারটি নিয়ে শুরু হয় অশুভ খেলাধুলা। যা আজও থেমে নেই। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন এক্ষেত্রে কোন এক অজানা কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। যদিও এর আগে মুন্নু সিরামিকের দরবৃৃদ্ধির তদন্ত কমিটি গঠনের ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। উল্টো কোম্পানির অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি ঘটেছে। কারণ মুন্নু গ্রুপের এই দুই কোম্পানি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগেই জেনে গত ৯ মাসে ধরে বাজারের একটি চক্র বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। স্পষ্টত সেখানে সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। যা সবারই নজরে এসেছে। কিন্তু কমিশনের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। জানা গেছে, গত ২০১০ সালেও শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ৩৭০ টাকা। সেই শেয়ারের বাজারদর এখন এক হাজার ৩৮৮.৬০ টাকা। চলতি তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশের দিন কোম্পানিটির পক্ষ থেকে ৩০০ শতাংশ রাইট শেয়ারের ঘোষণা আসবে- এমন গুজবে শেয়ারটির দর বাড়ছে। বর্তমানে এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার রয়েছে চার লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে ২ লাখ ৮ হাজার শেয়ার ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর ২০১১ সালের ১৫ নবেম্বর শেয়ারটি সর্বনিম্ন ১১৪ টাকায় নেমেছিল। মাঝে কিছুটা উত্থানের পর ২০১২ সালের ২২ জুলাই পুনরায় শেয়ারটির দাম কমে। এরপর সর্বশেষ পাঁচ বছরে মোট ছয় দফায় স্বল্প সময়ে শেয়ারটির দরে বড় উত্থান হয়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে দুই মাসে দেড়শ টাকা থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়। ২০১৬ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যে আড়াইশ টাকা থেকে ৩৮০ টাকা ছাড়ায়। গত বছরের জুলাইয়ের শুরুতে শেয়ারটি ৪৫০ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। এরপর মাত্র পৌনে দুই মাসে তা প্রায় ৮০০ টাকায় ওঠে। এরপর টানা প্রায় পাঁচ মাস নিম্নমুখী ধারায় ৬০০ টাকায় নামে। গত জানুয়ারি থেকে সর্বশেষ দফায় অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির ধারা শুরু হয়। ১৬ জানুয়ারি শেয়ারটি ৬৩৮ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। এক মাসের ব্যবধানে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শেয়ারটির দর ওঠে ৯৪৮ টাকা। এরপর কয়েক দিনের দরপতনের ফলে গত ২২ মার্চ ৭৪৬ টাকায় নামে। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয় নতুন উত্থান পর্ব। সবচেয়ে বড় উত্থান শুরু হয় ২৯ মার্চ থেকে ওই দিন থেকেই মূলত উচ্চ লেনদেনসহ কোম্পানির টানা বিক্রেতাশূন্য অবস্থায় লেনদেন হয়। এরপরে আরও মাত্র একদিন শেয়ারটির সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়নি। বাকি নয়দিন বিক্রেতাশূন্য অবস্থায় লেনদেন হয়েছে। এটি যেন আলাদিনের চেরাগে পরিণত হয়েছে। যে দামেই ক্রেতারা শেয়ার কিনছেন লাভের মুখ দেখছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।
×