ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখ বরণ সঙ্কোচন

দেশব্যাপী উদীচীর প্রতিবাদ সমাবেশ কাল

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১২ এপ্রিল ২০১৮

দেশব্যাপী উদীচীর প্রতিবাদ সমাবেশ কাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সময় নিয়ন্ত্রণ এবং মুখোশ ব্যবহারে সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিবাদে আগামীকাল শুক্রবার দেশব্যাপী কর্মসূচী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সরকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে সংগঠনটির উদ্যোগে আগামীকাল বিকেল চারটায় দেশব্যাপী একযোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ হবে। এ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল মিলনায়তনে বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলন হয়। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন উদীচী’র সাবেক সভাপতি কামাল লোহানী, সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য শংকর সাঁওজাল প্রমুখ। শুরুতে কর্মসূচী সম্পর্কে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন। বক্তারা বলেন, উদীচী মনে করে বিকাল পাঁচটার মধ্যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শেষ করা এবং মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার নিষেধ করা বিষয়ক সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত নিন্দনীয়। সংস্কৃতি কর্মীসহ সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষের প্রবল আপত্তির মুখেও গত কয়েক বছর ধরে বর্ষবরণ উৎসবকে নির্দিষ্ট সময়ের ঘেরাটোপে বেঁধে দেয়ার একতরফা পদক্ষেপ নিয়ে আসছে সরকার। এর মাধ্যমে উৎসবমুখর বাঙালীর প্রাণের উচ্ছ্বাসকে দমন করা হচ্ছে তাই, নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বিকাল পাঁচটার মধ্যে সব অনুষ্ঠান শেষ করার এ নির্দেশনা গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী প্রশ্রয় পাবে। এছাড়া, বৈশাখ উদ্যাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বিষয়ক যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সার্বিকভাবে উৎসবের বৈচিত্র্যকে খর্ব করবে। বক্তারা আরও বলেন, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান এ দেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল। তারা রুদ্ধ করতে চেয়েছিল সহস্র বছরের বাঙালীর আচার, ঐতিহ্য ও গৌরবের সংস্কৃতিকে। এ মাটি থেকে উৎসারিত, মাটিবর্তী মানুষের শ্রম ও ঘামের অতুল নিদর্শন বাংলা নববর্ষ এবং চৈত্র সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পহেলা বৈশাখের উৎসব তারা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে পহেলা বৈশাখসহ নানা সাংস্কৃতিক উৎসব-আচারকে তারা হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু এ দেশের উদার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্য ধর্মাবলন্বী মানুষ জাতি পরিচয়কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল বারবার। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, এ দেশে বসবাসকারী মানুষগুলো ধর্মে বর্ণে বিভেদকে কখনই পাত্তা দেয়নি। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসেও সেই পুরনো অপশক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের লড়াই লড়তে হবে, এটা আমরা ভাবতেও পারিনি। দেশের শাসনযন্ত্র বারবারই করায়ত্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাবিরোধী শক্তির হাতে। তাদের হাতেই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। ফলে এখনও মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ আমরা পাইনি। বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতি, হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোর বিরুদ্ধে বারবার বিষোদ্গার ও অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আমাদের সংস্কৃতিশূন্য অমানবিক জাতিতে রূপান্তর করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সম্প্রতি পহেলা বৈশাখের মতো বাঙালীর স্বতঃস্ফূর্ত লৌকিক উৎসবের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। তারা প্রকাশ্যে আমাদের সমৃদ্ধ এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা ২০০১ সালে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বর্বর বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষকে। তারা ভেবেছিল এভাবেই প্রাণের উৎসব থেকে বাঙালীকে বিচ্যুত করতে পারবে। কিন্তু তারা আজ পরাজিত। এতবড় হামলার পরও বাঙালী বহুগুণ উৎসাহে বর্ষবরণ উৎসবে মিলিত হয় প্রতিবছর। কোন রক্তচক্ষু, হত্যা, হামলার ভয় বাঙালীকে উৎসববিমুখ করতে পারেনি। এরপরও পহেলা বৈশাখের এ আয়োজনকে রুদ্ধ করতে থেমে নেই ষড়যন্ত্র। কারণ এ আয়োজন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর জন্য আতঙ্কের। কেননা এ উৎসবে নিহিত রয়েছে বাঙালীর ঐক্য, সকল সম্প্রদায়ের অভাবিত সম্মিলন এবং সংগ্রামের প্রেরণা। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কোটি মানুষ উৎসবে মিলিত হয়। রাজপথ থেকে অলিগলি মেতে উঠে নব আনন্দে। ফলে পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে যে কোনভাবে কালিমালিপ্ত করতে উদ্যত অপশক্তি। সম্প্রতি এ শক্তিটি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা হামলার ভয় দেখিয়ে আবারও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে রদ করতে চায়। নিরাপত্তার অজুহাতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পহেলা বৈশাখের উৎসবের সময় সঙ্কোচনের নীতি গ্রহণ করেছে। যেখানে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলার হুমকিকে চ্যালেঞ্জ করে উৎসবকে অবারিত করার উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল সেখানে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপশক্তির হুমকিতে জড়োসড়ো। তারা বিকেল ৫টা পর্যন্ত পহেলা বৈশাখের উৎসবের সময় বেঁধে দিয়ে প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যা মোটেই কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ যেখানে এ উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্ভীক সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যুৎসাহী ভূমিকা এবং সরকারের ভয় আমাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া যায় না। উদীচী সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। জেলা উপজেলা, গ্রামে-গঞ্জে উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গান, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, যাত্রা, পুতুল নাচ, ইত্যাদি বিচিত্র লোকজ পরিবেশনার সঙ্গে মুড়ি, মুড়কির পসরা নিয়ে নববর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে ব্যাপক রূপ দেয়ার প্রস্তুতি চলছে সারাদেশে। আমরা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সময় সঙ্কোচনের সরকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। পহেলা বৈশাখ ও বাঙালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি দাতাদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া, বৈশাখ উদ্যাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বিষয়ক যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সার্বিকভাবে উৎসবের বৈচিত্র্যকে খর্ব করবে, তাই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। উদীচী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সকল অপশক্তি রুখতে হবে। পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের আয়োজনে জনগণ যেভাবে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাস্তায় নামে তার প্রতি দায়িত্বশীল ও সশ্রদ্ধ হবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
×