ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ ॥ এডিবি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ এপ্রিল ২০১৮

চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ ॥ এডিবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছর (২০১৭-২০১৮) শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হবে বলে মনে করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির নিয়মিত প্রতিবেদন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউট লুকে এ পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এডিবি কার্যালয়ে আউটলুক প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংস্থাটি আরও বলছে, আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও সরকারী হিসাবে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধির এ হার হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির সরকারী হিসাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রশ্ন তুললেও এডিবি বলছে, তথ্য-উপাত্তের পার্থক্যের কারণে পরিসংখ্যান ভিন্ন হতে পারে। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এটাই বড় কথা। পরপর তিন বছর ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এটারই প্রমাণ। একই দিন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক বা এডিবি কেউই আমাদের প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রত্যাখ্যান করেনি, কিছু প্রশ্ন তুলেছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। প্রশ্নগুলোর উত্তরও আমাদের কাছে আছে। তারা চাইলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে দেখতে পারে। মন্ত্রী আরও বলেন, রক্ষণশীল পদ্ধতিতে নয় মাসের হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থনীতির সব সূচক ভাল অবস্থানে আছে। অর্থবছর শেষে ১২ মাসের হিসাবে চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এডিবির সংবাদ সম্মেলনে আউটলুকের বাংলাদেশ বিষয়ক মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংস্থাটির ইকনোমিস্ট সুন চ্যান হং। এ সময় এডিবির বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে মনমোহন প্রকাশ স্বল্পোন্নত দেশের এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণে প্রাথমিক মূল্যায়নে যোগ্যাতা অর্জন করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা এলডিসি থেকে উত্তরণের তিনটি শর্তই পূরণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারসাম্যেরও মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিও শক্ত অবস্থানে। রাজস্ব ঘাটতিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। তবে দেশকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়বে। পোশাক শিল্পের বৈচিত্র্য ও শ্রমঘন শিল্প খাতে গুরুত্ব দেয়া হলে আগামীতে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। তাছাড়া আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চলতি অর্থবছর কৃষি খাতে ২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধারণা দিয়েছে এডিবি। গত বছর ৩ খাতে পূর্বাভাস ছিল ৩ শতাংশ। এবার শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হবে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। রফতানি বেড়ে যাওয়ার কারণে শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়বে। সেবা খাতে এ সময়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এডিবি বলছে, রফতানি সম্প্রসারণের গতি কমে আসার পাশাপাশি রেমিটেন্সে নিম্ন গতি সত্ত্বেও গতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রবণতাও কমেছে। তবে চলতি হিসেবে ঘাটতি বেড়েছে। চলতি অর্থবছর কৃষি ও সেবা খাতে ধীরগতি সত্ত্বেও অর্থনীতির ভাল প্রবৃদ্ধি হবে। তবে এ সময়ে চলতি হিসেবে ঘাটতি আরও বাড়বে। তবে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে শিল্পের ভিত্তি শক্তিশালী করার পাশাপাশি রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতিগত সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে এডিবি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে হবে ৬ দশমিক ১ শতাংশ ॥ এডিবির মতে, চলতি অর্থবছরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ১ শতাংশে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তেল ও অন্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাবে। প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুতের দামের সমন্বয় করা এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আহরণে ৩১ দশমিক ৮০ শতাংশ ও ব্যয়ে ২৬ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল। উন্নয়ন খাতে ৩৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়তি ব্যয় ধরায় পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, রূপপুর, পায়রা বন্দর, রামপাল ও মাতারবাড়ির মতো মেগা প্রকল্পে গতি আসার সম্ভাবনা ছিল। রাজস্ব আয় জিডিপির ১৩ শতাংশ ও সরকারী ব্যয় জিডিপির ১৮ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। আয় ও ব্যয় বৃদ্ধিও বিশাল লক্ষ্যমাত্রা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রত্যাশিত হারে আয় ও ব্যয় না হওয়ায় বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯০ দেশের মধ্যে ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। দেশের সম্ভাবনাকে উন্নয়নে রূপান্তর করতে বাংলাদেশে ব্যবসার উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এখানে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। বিদ্যুত, সড়ক ও রেলওয়ের মতো অবকাঠামোতে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। বর্তমানে দেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ৩ শতাংশ। উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে তা ৬ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। দেশের কর কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে। বাড়তি রাজস্ব আহরণে ভ্যাট আইন কার্যকর করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিও পাশাপাশি প্রতিযোগিতা সক্ষমতার বিবেচনায আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চেয়েছে এডিবি। পরিকল্পনামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন ॥ একই দিন শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রক্ষণশীল পদ্ধতিতে নয় মাসের হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থবছর শেষে ১২ মাসের হিসাবে চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। মন্ত্রী বলেন, বিবিএসের কাছে চলতি অর্থবছরের নয় মাসের হিসাব আছে। আমি বিশ^ব্যাংককে মে মাস পর্যন্ত সময় দিলাম। এর মধ্যে যে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তাদের সংশয়-সন্দেহ আছে সেগুলো বিবিএসের মাধ্যমে তারা যাচাই করে নিতে পারবেন। আমাদের মধ্যে কোন লুকোছাপা নেই। বিশ^ব্যাংক বর্তমানে বিবিএসের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে। তাই খুব সহজেই তারা তথ্য যাচাই করতে পারবেন। আশা করি, তথ্য যাচাইয়ের পর প্রবৃদ্ধি বিষয়ে তাদের যে সংশয় তা দূর হবে এবং তারা তাদের প্রতিবেদনেও তা উল্লেখ করবেন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিও একই আহ্বান জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিবিএস একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত ও সুনির্দিষ্ট রীতি নীতি মেনেই তারা প্রবৃদ্ধির হিসাব করে। এবার প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। কোন কোন খাতের আট মাসের তথ্যও ব্যবহার করা হয়েছে। অবশিষ্ট তথ্য নেয়া হয়েছে আগের অর্থবছরের চূড়ান্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং রক্ষণশীল পদ্ধতিতেই করা হয়েছে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির সব খাত ভাল অবস্থানে রয়েছে। তাই আমি মনে করি, অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হিসাব ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশকে ছাড়িয়ে যাবে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রবৃদ্ধিও হিসাব ছাড় বিশ^ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ব্যাপক প্রশংসা করেছে। অর্থনীতির উন্নতির জন্য তারা কিছু সুপারিশও করেছে, যেগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গে আমিও একমত। তবে বিশ^ব্যাংক বলেছে অনুন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিতে হবে। তাদের এ পরামর্শেও সঙ্গে আমি একমত নই। কেননা আমাদের সব প্রকল্পই বিনিয়োগ প্রকল্প। এগুলো নেয়ার সময় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই হাতে নেয়া হয়। যেসব প্রকল্প বিশ^ব্যাংকের কাছে অনুন্নয়ন মনে হয়েছে সেগুলো আমাদের দেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। নয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন ৪৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ ॥ মন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (আরএডিপি) বাস্তবায়িত হয়েছে ৪৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ সময়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে ৭১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৪৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। ওই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৫৩ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। আশা করছি অর্থবছর শেষে শতভাগ সংশোধিত এডিপিই বাস্তবায়ন হবে।
×