ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কংগ্রেসের পথেই হাঁটছেন মোদি

প্রকাশিত: ০৭:২২, ১১ এপ্রিল ২০১৮

কংগ্রেসের পথেই হাঁটছেন মোদি

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ কর্নাটকে সম্প্রতি এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেস পরিচালিত স্থানীয় রাজ্য সরকারকে অভিযুক্ত করে বলেন, ‘এই সরকার প্রতিটি কনট্রাক্ট থেকে ১০ পার্সেন্ট বাগিয়ে নিচ্ছে। আপনারা কি কমিশন খাওয়া সরকার চান, না মিশন সরকার চান?’ তার অর্থ চার মাস ক্ষমতায় থাকার পরও নরেন্দ্র মোদি প্রতিপক্ষকে অপদার্থ, অলস ও দুর্নীতিবাজ বলে ধোলাই দিয়ে যে আনন্দ পান আর কোন কিছুতেই তা পান না। কিন্তু তার সরকারও যে ক্রমশ তেমনই হতে যাচ্ছে সেটা সম্ভবত তিনি ভুলে যাচ্ছেন। জনসভায় মোদির সেই অভিযোগের কন্ট্রাক্টের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইকা টুইটারে একটা কার্টুন পোস্ট করেন যেখানে দেখানো হয় বড় ব্যাংক নোট বাতিল হওয়ার পর অসংখ্য সাধারণ মানুষ চিন্তিত মুখে নোট ভাঙাতে ব্যাংকের সামনে লাইন দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাংকে ভাঙিয়ে দেয়ার মতো টাকা নেই। অন্য দিকে ব্যাংকের পেছন দিকে কোটিপতিরা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের দিকে প্রসন্ন বদনে হাত নাড়ছে মোদি চেহারার এক ব্যক্তি যার গায়ে ‘চৌকিদার’ শব্দটি লেখা। কার্টুনটির বক্তব্য স্পষ্ট। গত নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের আগে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি দেশের অতন্দ্র চৌকিদারের ভূমিকা পালন করবেন। অথচ কংগ্রেস যে ধরনের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি করেছিল তাঁর আমলেও তেমনি দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি চলছে। সর্বশেষ ঘটনায় এক ডায়মন্ড ব্যবসায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের প্রায় ১৮ কোটি ডলার জালিয়াতি করে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে সুইজারল্যান্ডের পার্বত্য অবকাশকেন্দ্র ডাভোস মোদির সঙ্গে ভারতীয় পুঁজিপতি ও ধনকুবেরদের দহরম-মহরমের একটি ছবিতে দেখা গিয়েছিল। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই মোদির পক্ষে কংগ্রেসের অপশাসনের বিশুদ্ধ বিকল্প হিসেবে নিজেকে ইমেজ ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। কংগ্রেসী অপশাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি। কিন্তু তার বিজেপি সরকার বিস্ময়করভাবে ক্রমশ সেই কংগ্রেসেরই অনুরূপ শাসনের দিকে বিবর্তিত হয়েছে। বিজেপি উত্তরোত্তর রাষ্ট্রের পার্টির রূপ ধারণ করছে। বিলবোর্ড ও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে শোভা পাচ্ছে মোদির ছবি। রাষ্ট্রীয় টিভি ও বেতারে শোনা যাচ্ছে মোদির কণ্ঠস্বর। তাঁর অনুগতরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সরকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করছে। তাই দেখা যায়, বিজেপির কেউকেটারা অন্যায় বা অপকর্ম করেও পুলিশ ও আদালতের হাত থেকে সহজেই অব্যাহতি পেয়ে যাচ্ছে। দুই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশন মোদির ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করেছে বলে সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তে দেখা গেছে। উদ্যোমী প্রধানমন্ত্রী কয়েক ডজন বহুল প্রচারিত সমাজ উন্নয়ন কর্মসূচী চালু করেছেন। তবে তাঁর সরকার কংগ্রেস আমলের বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে সোজা সেগুলোকে নতুন নামকরণ করেছে। যেমন ২০১২ সালে বেসিক সেভিংস ব্যাংক ডিপোজিট এ্যাকাউন্ট নামে একটি স্কিম, গরিবদের ব্যাংক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে চালু করা হয়েছিল। সেটির এখন নতুন নাম হয়েছে প্রাইম মিনিস্টার্স পিপলস্্ সানি প্রজেক্ট। কোন কোন ক্ষেত্রে মোদি এমন সব নীতি নিয়েছেন সেগুলোর শাণিত সমালোচনা তিনি বিরোধী দলে থাকাকালে করতেন। যেমন কংগ্রেস আমলে চালু করা বায়োমেট্রিক আইডি কার্ড প্রকল্পকে তিনি প্রতারণাপূর্ণ কৌশল বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রকল্পটির নাম ছিল আদহার। কার্যক্ষেত্রে তাঁর সরকার মোবাইল ফোন লাইন থেকে শুরু করে খাদ্য ভর্তুকি পর্যন্ত সবকিছুর জন্য আদহার কার্ড বাধ্যতামূলক করেছে। নানা ধরনের স্থানীয় করের পরিবর্তে জাতীয় পণ্য ও সেবা কর নামে একটি মাত্র কর চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল কংগ্রেস সরকার। বিজেপি তখন বারংবার সমালোচনার কশাঘাত জেনেছিল সরকারকে। অথচ গত বছর বিজেপি সরকারই মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে পণ্য ও সেবা কর চালু করেছে। গ্রামাঞ্চলের আয় বাড়াতে কংগ্রেসের নেয়া কর্মসূচীকে মোদি ভোট কেনার জন্য অর্থের অপচয় বলে সমালোচনা করেছিলেন বার বার। অথচ তার সরকারই এই খাতে ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলো ঋণগ্রস্ত কৃষকদের স্বস্তি দেয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নানাভাবে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য সেক্যুলার কংগ্রেসকে সমালোচনায় জর্জরিত করতে ছাড়েনি বিজেপি। অথচ গত মাসে মেঘালয় ও ত্রিপুরার নির্বাচনী প্রচারে এই দলটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে যেভাবে মাতামাতি করেছে তা বিরল। মেঘালয়ের খ্রীস্টানদের বিনা খরচে জেরুজালেমে তীর্থ যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলটি। ত্রিপুরায় বিজেপি এমন এক দলের সঙ্গে মিত্রতা করেছে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ী সমাজ মোদিকে ঢালাও সমর্থন দিয়েছিল। তাদের অনেকে মোদির কিছু কিছু অর্জনের প্রশংসা করে থাকেন। কিন্তু এমনও অনেকে আছেন যারা তাঁর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ও সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সাম্প্রতিক কিছু বিপর্যয়ের পর ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা মোদির পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনায় উত্তরোত্তর মুখর হয়ে উঠেছেন। ভারতের ঘোর শত্রু চীন ভারতের চিরাচরিত প্রভাবলয়ে স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে জম্মু ও কাশ্মীরে অসন্তোষ দমনে কঠোর নির্যাতন নীতি সরকারকে স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। মোদি সরকারের জন্য এটা নিশ্চয়ই সুখকর নয়। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×