ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মন্টিভিডিও টু মস্কো

বিশ্বকাপকথন-১৩ ॥ একাদশ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা : ১৯৭৮

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১১ এপ্রিল ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-১৩ ॥ একাদশ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা : ১৯৭৮

একুশতম বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আর মাস দুয়েক বাকি। প্রস্তুত রাশিয়ার মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামে এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক রাশিয়ার মুখোমুখি হবে এশিয়ার সৌদি আরব। ১৫ জুলাই ৮১ হাজার আসনের একই মাঠে সমাপনী (ফাইনাল) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথা সবার জানা, এবারের ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে রাশিয়ায়। এবারের ২১তম বিশ্বকাপে ৩২ দল অংশ নেবে। কোন্্ ৩২ দল ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেবে সেটাও এখন সবার জানা হয়ে গেছে। রাশিয়ার ১২ স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ৬৪ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথাও সবার জানা, ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন...প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ ফিফা কাপের দ্বিতীয় আসরের আয়োজনের দায়িত্ব পায় আর্জেন্টাইনরা। আবার লাতিনে। ঘুরে ফিরে সেই ইউরোপ-আমেরিকা ‘বাঘাডুলি’ খেলা চলতে থাকে। বিশ্বকাপের ১১টি আসরের ৬ বার ইউরোপে বাকি ৫ বার ল্যাটিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমেরিকা-ইউরোপের গ-িতেই আটকে থাকল বিশ্বকাপ ফুটবল। আর্জেন্টিনা এবারই প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেল। যদিও ১১তম বিশ্বকাপে ততটা ফেবারিট ছিল না আর্জেন্টাইনরা। তাদের কাপ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন ম্যানেজার সিজার লুই মেনত্তি। বলা যায়, তারই অনুপ্রেরণায় আর্জেন্টিনা একটি সাধারণ দল থেকে অপ্রতিরোধ্য দলে পরিণত হয়। আর তার নেপথ্য হিরো ছিলেন এই চেইন স্মোকার কোচ কাম ম্যানেজার মেনত্তি। আয়োজকের দায়িত্ব পাবার পর মেনত্তি আর্জেন্টিনা দলকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজান। মেনত্তির দল গঠনে আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থকরা তো বটেই সঙ্গে তামাম ফুটবল-বিশ্ব হতবাক না হয়ে পারেনি। ইউরোপের বিভিন্ন লিগে আর্জেন্টিনার অনেক প্রতিভাবান তারকা খেলোয়াড় খেলছিলেন। মেনত্তি একমাত্র স্পেন লিগে খেলতে থাকা মারিও কেম্পেস ছাড়া বাকি সবাইকে উপেক্ষা করেন। এটা ছিল তার একটি চ্যালেঞ্জিং ডিসিশন। সবার মতকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ একটি নতুন দল গঠন করেন মেনত্তি। এমন কী সে বছর আর্জেন্টিনা লিগ চ্যাম্পিয়ন বোকা জুনিয়র্সের একজন ফুটবলারকেও তিনি দলে নেননি। তার কারণেই ম্যারাডোনার এ বছর বিশ্বকাপ অভিষেক হলো না। অপরিণত বলে ‘বিস্ময় বালক’ ম্যারাডোনাকে দলের বাইরে রাখেন মেনত্তি। দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তার এ সব দোষ গুণে পরিণত হয়। ফিফার ১৪৫টি সদস্য দেশের ভোটে আয়োজক নির্বাচিত হলো আর্জেন্টিনা। এবারও দশম বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলল আগের মতোই ১৬টি দেশ। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ থেকে : ইতালি, প. জার্মানি, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, সুইডেন, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড; কনমোবল থেকে : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু; কনকাকাফ থেকে : মেক্সিকো; ওশেনিয়া থেকে : অস্ট্রেলিয়া; আফ্রিকা থেকে : তিউনিশিয়া এবং এশিয়া থেকে : ইরান এ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এই ১৬টি দল নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ১০৬টি দেশের মধ্যে থেকে। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ২৫১টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে ১৬টি দল খেলল ৩৮টি ম্যাচ। জার্মানির ৫টি স্টেডিয়ামে এই ৩৮টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। দশম বিশ্বকাপের মতো এবারো আবার গ্রুপিং করা হয়। গ্রুপপর্বে ১৬টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি করে দল অংশ নেয়। দশম বিশ্বকাপের নিয়মে এবারও খেলা হয়। খেলার নিয়ম ছিল এ রকম, গ্রুপ পর্বের ১৬টি দলের ৮টি দল অর্থাৎ দুই ৪ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দল দুই পর্বে দ্বিতীয় রাউন্ডে রবিন লিগ খেলবে। দ্বিতীয় রাউন্ডের দুই গ্রুপের শীর্ষ দুই দল ফাইনাল খেলবে। কোন কোয়ার্টার-ফাইনাল বা সেমি-ফাইনাল হবে না। ১৬টি দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা হয় এভাবে: গ্রুপ ১ : ইতালি, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স ও হাঙ্গেরি; গ্রুপ ২ : প. জার্মানি, পোল্যান্ড মেক্সিকো ও তিউনিসিয়া; গ্রুপ ৩ : ব্রাজিল, সুইডেন, স্পেন ও অস্ট্রিয়া; গ্রুপ ৪ : নেদারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, পেরু ও ইরান এ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। এরপর চার গ্রুপের গ্রুপ থেকে ৮টি দল দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। গ্রুপ পর্বে প. জার্মানি ৬-০ গোলে হারায় মেক্সিকোকে, দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনা ৬-০ গোলে পেরুকে নেদারল্যান্ডস ৫-১ গোলে অস্ট্রিয়াকে হারায়। প্রথম রাউন্ডের খেলার পর দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শেষে দ্বিতীয় রাউন্ডের দলগুলোর অবস্থান: গ্রুপ এ থেকে নেদারল্যান্ডস, ইতালি, প. জার্মানি ও অস্ট্রিয়া এবং গ্রুপ বি থেকে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পোল্যান্ড ও পেরু প্রথম রাউন্ডের দেয়াল পার হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলে। অর্থাৎ দ্বিতীয় রাউন্ডে গ্রুপ-এ থেকে নেদারল্যান্ডস এবং গ্রুপ-বি থেকে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়। ব্রাজিল বি প্রুপে আবারও রানার্স আপ হওয়ায় ফাইনাল খেলার সুযোগ হারায়। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : গ্রুপ-এ : ইতালি-২ ফ্রান্স-১; আর্জেন্টিনা-২ হাঙ্গেরি-১; ইতালি-৩ হাঙ্গেরি-১; আর্জেন্টিনা-২ ফ্রান্স-১; ফ্রান্স-৩ হাঙ্গেরি-১; ইতালি-১ আর্জেন্টিনা-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ইতালি গ্রুপ রানার্স আপ : আর্জেন্টিনা। গ্রুপ-বি : প. জার্মানি-১ পোল্যান্ড-০; তিউনিশিয়া-৩ মেক্সিকো-১; পোল্যান্ড-১ তিউনিশিয়া-০; প. জার্মানি-৬ মেক্সিকো-০; পোল্যান্ড-৩ মেক্সিকো-১; প. জার্মানি-০ তিউনিশিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : পোল্যান্ড গ্রুপ রানার্স আপ : প. জার্মানি। গ্রুপ-সি : ব্রাজিল-১ সুইডেন-১; অস্ট্রিয়া-২ স্পেন-১; ব্রাজিল-০ স্পেন-০; অস্ট্রিয়া-১ সুইডেন-০; ব্রাজিল-১ অস্ট্রিয়া-০; স্পেন-১ সুইডেন-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : অস্ট্রিয়া গ্রুপ রানার্স আপ : ব্রাজিল। গ্রুপ-ডি : পেরু-৩ স্কটল্যান্ড-১; নেদারল্যান্ডস-৩ ইরান-০; ইরান-১ স্কটল্যান্ড-০; পেরু-০ নেদারল্যান্ডস-০; পেরু-৩ ইরান-১; স্কটল্যান্ড-৩ নেদারল্যান্ডস-২; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : পেরু গ্রুপ রানার্স আপ : নেদারল্যান্ড। দ্বিতীয় রাউন্ড : গ্রুপ-১ : প. জার্মানি-০ ইতালি-০; নেদারল্যান্ডস-৫ অস্ট্রিয়া-১; প. জার্মানি-২ নেদারল্যান্ড-২; অস্ট্রিয়া-৩ প. জার্মানি-২; ইতালি-১ অস্ট্রিয়া-০; নেদারল্যান্ডস-২ ইতালি-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : নেদারল্যান্ডস গ্রুপ রানার্স আপ : ইতালি। দ্বিতীয় রাউন্ড : গ্রুপ-২ : ব্রাজিল-৩ পেরু-০; আর্জেন্টিনা-২ পোল্যান্ড-০; পোল্যান্ড-১ পেরু-০; আর্জেন্টিনা-০ ব্রাজিল-০; ব্রাজিল-৩ পোল্যান্ড-১; আর্জেন্টিনা-৬ পেরু-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : আর্জেন্টিনা গ্রুপ রানার্স আপ : ব্রাজিল। তৃতীয় স্থান : ব্রাজিল-৩ ইতালি-১ ফাইনাল : আর্জেন্টিনা-৩ নেদারল্যান্ড-২ (কেম্পেস, বার্তৈনি) (নানিনগা) চ্যাম্পিয়ন : আর্জেন্টিনা রানার্স আপ : নেদারল্যান্ডস তৃতীয় স্থান : পোল্যান্ড। অন্য সব বিশ্বকাপের মতো এবারও ফেবারিট ছিল ব্রাজিল। দশম বিশ্বকাপের মতো এবারো ব্রাজিল ঠেকাও আন্দোলন অব্যাহত থাকে। আগেরবার করেছিল ইউরোপের দলগুলো, আর এবার করে লাতিন দলগুলো। মেনত্তির কৌশল আর পেরুর বিশ্বাসঘাতকতা ব্রাজিলকে কাপ জিততে দেয়নি। পেরু আর্জেন্টিনার সঙ্গে যোগসাজশ করে ০-৬ গোলে স্বেচ্ছা পরাজয় বরণ করে। আর্জেন্টিনার সঙ্গে পেরুর এই পাতানো খেলার কারণে গোল গড়ে ব্রাজিলের ফাইনালে যাওয়া হয়নি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটি একটি নিঃসন্দেহে নিন্দিত ও কালো অধ্যায়। এতে করে কেবল ব্রাজিল যে কাপ পায়নি তা নয়, বিশ্বকাপের সৌন্দর্যও হানি হয়েছে। পেরুর বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রাজিলকে তৃতীয় স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে ব্রাজিলের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসকেও ফেবারিট ভাবছিলেন অনেকে। ডাচদের ‘টোটাল ফুটবল’ই তাদের বুকে কাপ জেতার স্বপ্নের বীজ বুনে দেয়। আগের বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠেও কাপ ছুঁতে পারেনি। এবার আর সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ডাচরা। সবাই ভাবছিল, ১১তম বিশ্বকাপ ডাচদের ঘরেই উঠবে। বাস্তবে সেটা হয়নি। হতে দেননি মারিও কেম্পেস-বার্তেনি। ফাইনালে কেম্পেস ২টি এবং বার্তেনি ১টি গোল করে আর্জেন্টিনাকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন। নেদারল্যান্ডসের নানিগা ১টি গোল করলেও তা জয়ের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। বিরূপ পরিবেশ, হোস্ট ক্রাউডের চাপ সব মিলিয়ে শেষটা সুখকর হয়নি ডাচদের। কাপ জেতে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন। যাকে বলা যায়, মেডেন চ্যাম্পিয়ন। আর এ চ্যাম্পিয়ন হবার সুবাদে মেনত্তির সব অপরাধ মাফ। তৃতীয় স্থান পায় ব্রাজিল। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তারা ২-১ গোলে হারায় ইতালিকে। একাদশ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার নেতৃত্ব দেন ড্যানিয়েল আর নেদারল্যান্ডসের রুডিক্রল। একাদশ বিশ্বকাপে মোট ১০২টি গোল হয়। একাদশ বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেস। তিনি এ বিশ্বকাপে ৬টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। হ্যাট্রিক করেন পেরুর কুবিল্লাস। একাদশ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন ইতালির রেফারি এস গোনেলা। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ বাংলাদেশ ও ভারতে প্রকাশিত দুই শতাধিক বইয়ের লেখক e-mail : [email protected]
×