ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তারেক রহমানের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১১ এপ্রিল ২০১৮

তারেক রহমানের মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে লন্ডনে এক অভিজাত হলে বাংলাদেশের বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখা এক সমাবেশের আয়োজন করেছিল। তাতে মূল বক্তা ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান। তিনি সুট-টাই পরে চোখে চশমা লাগিয়ে (পিতার কালো চশমাটি নয়) মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। আমার এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু সম্ভবত ঠাট্টা করে বলেছেন, ভারতে সোনিয়া পুত্র রাহুল গান্ধী এখন কংগ্রেসের নেতা, বাংলাদেশে খালেদা পুত্র তারেক রহমান বিএনপির নেতা। এখন হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের নেতা হলে এশিয়ার রাজনীতিতে তারুণ্যের জয়জয়কার হবে। আমি তাকে বলেছি, এশিয়ার রাজনীতিতে তারুণ্যের এই জয়জয়কার হতে হয়ত একটু দেরি আছে। রাহুল গান্ধী অবশ্য রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে নেমেছেন। সজীব জয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে নামেননি। তিনি রাজীব গান্ধীর মতো একজন টেকনোক্রাট। যতদূর জানি, রাজনীতিতে জড়িত হতে খুব আগ্রহী নন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত কি হবে তা বলতে পারি না। অন্যদিকে তারেক রহমান দুর্নীতির হাওয়া ভবনের রাজা ছিলেন। হত্যা, সন্ত্রাস, বেপরোয়া দুর্নীতির দায়ে দ-প্রাপ্ত ব্যক্তি। তদুপরি দীর্ঘকাল ধরে বিদেশে পলাতক। তার বেলাতেও শেষ পর্যন্ত কি হবে বলা যায় না। যাহোক এই তারেক রহমান লন্ডনে আছেন তা প্রায় দশ বছরের কাছাকাছি হয়ে গেল। বিলাতে তার রাজনীতি হচ্ছে, সুযোগ বুঝে তার লন্ডনের বাঙালী চেলা চামু-াদের দ্বারা রাজকীয় স্টাইলে সভা সম্মেলন করা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অশালীন ও অসত্য কথাবার্তা বলা এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে এলে তার পেছনে তার দলের মাস্তানদের লেলিয়ে দেয়া। সম্প্রতি লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে এই মাস্তানদের দ্বারা হামলা চালাতে গেলে তাকে ব্রিটিশ সরকারের ধমক খেতে হয়েছে। তিনি বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছেন। এই হচ্ছে তারেক রহমানের সাম্প্রতিক রাজনীতি। দেশে ফিরে গিয়ে আর বিরুদ্ধে আদালতে যেসব মামলা মোকদ্দমা চলছে, সেগুলো মোকাবেলা করা ও প্রত্যক্ষভাবে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের সাহস তার নেই। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিই তার একমাত্র মূলধন। বিলাতে প্রায় দশ বছর আছেন। এই সুযোগে তিনি যে কিছু লেখাপড়া করবেন, নিজেকে একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে গড়ে তুলবেন, তাও পারেননি। তবু বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে তাকে বসিয়ে দিয়েছেন। আর এই নেতাও আশা করছেন তার ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একদিন দেশে ফিরতে পারবেন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তবে এই আশার সঙ্গে তার মনে সম্ভবত আশঙ্কাও আছে। যদি আগামী নির্বাচনে তার দল যোগ না দেয় অথবা জয়ী না হয়, বেগম জিয়াকে আদালতের দেয়া পাঁচ বছরের সাজা পুরো ভোগ করতে হয় এবং বিএনপি সংগঠন হিসেবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তাহলে তিনি কি করবেন? বাংলাদেশ সরকার একজন দ-প্রাপ্ত আসামি হিসেবে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে অনবরত চাপ দিচ্ছে। এই চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার রাজি হতে পারে। এই আশঙ্কায় তারেক রহমান যে কোন মুহূর্তে লন্ডন ছেড়ে পাকিস্তান বা সৌদি আরবে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি রেখেছেন বলে বিলাতের বাজারে জোর গুজব। কতটা সত্য তা জানি না। রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পাকিস্তান ও কোন কোন আফ্রিকান দেশের স্বৈরাচারী মুসলিম শাসকেরা সৌদি আরবেই গিয়ে আশ্রয় নেন। উগান্ডার ইদি আমিন সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার জন্য সৌদি রাজধানী রিয়াদে একটি প্রাসাদতুল্য ভবন দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সৌদি আরবেই আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাকেও একটা মনোরম বাড়ি দেয়া হয়েছিল। পরে তিনি পাকিস্তানে গিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। বাংলাদেশে এক এগারোর সময় মাইনাস টু থিয়োরি বাস্তবায়নের জন্য যখন বেগম খালেদা জিয়াকে সৌদি আরবে পাঠানোর ব্যবস্থা হয় এবং তিনিও রাজি হন, তখন কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ইদি আমিন তো মারা গেছেন, তার বাসাটাই বেগম জিয়াকে এখন দেয়া হবে। পরে অবশ্য সৌদি আরবের ভিসা না দেয়ার কৌশলেই বেগম জিয়াকে আর সৌদি আরবে যেতে হয়নি। এখন অবশ্য রিয়াদে ইদি আমিন এবং নওয়াজ শরিফের দুটি সুরম্য প্রাসাদই খালি। তারেক রহমান সৌদি আরবে গেলে আরও আরাম আয়েশে থাকবেন। শুধু লন্ডনের ‘নাইট লাইফটি’ তিনি হারাবেন। কিছু ফেসবুকে তার যে নাইট লাইফের (কোন দুষ্টু লোকেরা দুষ্টুমি করেছে কিনা জানি না) ছবি দেখা যায়, তা সত্য হলে বুঝতে হবে তারেক রহমান বড় ‘কষ্টকর জীবন’ লন্ডনে কাটাচ্ছেন। এই তারেক রহমান গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আয়োজিত বিএনপির সভায় চশমা চোখে বক্তৃতা দিয়েছেন, সে কথা গোড়াতেই লিখেছি। তিনি পিতা জিয়াউর রহমানের সব ‘সৎ গুণেরই’ উত্তরাধিকারী। খরশব ভধঃযবৎ ষরশব ংড়হ। এই অবস্থায় পিতার কালো চশমাটি চোখে দিয়ে বক্তৃতা দিলে আরও ভাল করতেন। এই সভায় তিনি আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। তারেক রহমান মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। দেখার বয়স হয়নি। তাই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, তার মুক্তিযুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে? কেবল হাসিনা-সরকারের বিরুদ্ধে? তা কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো সশস্ত্র যুদ্ধ হবে? কয়েক বছর আগে তারই মহড়া কি বিএনপি-জামায়াত ঢাকার রাস্তায় ভয়াবহ সন্ত্রাসের মাধ্যমে দিয়েছে? আগামীতে সেই সন্ত্রাসকেই কি মুক্তিযুদ্ধ আখ্যা দেয়া হবে? আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ঠাট্টা করে বলেছেন, তারেক রহমানের এবারের মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা ভিন্ন। এটা কারাদ-ে দ-িত মাকে জেলমুক্ত করার মুক্তিযুদ্ধ। এর আর কোন ব্যাখ্যা নেই। আমি এই বন্ধুর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। তারেক রহমানের পিতা জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। ’৭১ সালে ত্রিপুরার কাছে সাবরুম সেক্টরে একজন মোটিভেটর হিসেবে আমি তার সঙ্গে মাস খানেক ছিলাম। তার যুদ্ধ ছিল ঘুম থেকে উঠে এক ঘণ্টা ধরে চুল আঁচড়ানো, আগরতলায় আসা বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলা এবং জেনারেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির পদ থেকে সরানোর গোপন তৎপরতা চালানো। মাঝে মাঝেই তিনি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, তিনি বার বার লোক পাঠানো সত্ত্বেও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া কেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী সেনাপতিদের আশ্রিত অবস্থা থেকে তার কাছে চলে আসছেন না? জেনারেল ওসমানী দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য তার কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা করছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অনুরোধে তাকে ক্ষমা করেন। তথাপি মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে তার নানা গোপন অভিসন্ধি ও তৎপরতার কথা জানাজানি হওয়ায় তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানকে তার জেড ফোর্সসহ যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের আইয়ুব খান যখন ব্রিটিশ আর্মিতে মেজর ছিলেন এবং বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধরত ছিলেন, তখন তার নিজের ইন্ডিয়ান ব্যাটেলিয়নের বিরুদ্ধে তিনি যে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে জড়িত হয়েছিলেন, তারই এক সহকর্মী ভারতীয় মেজর পরবর্তীকালে তার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন ‘প্রোট্রেট অব এ ট্রেইটর’ নামের এক বইতে। বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের পরম সৌভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধে তার ডাবল এজেন্টের ভূমিকার কথা তার কোন কোন সহকর্মীর জানা থাকা সত্ত্বেও তারা তা প্রকাশ করেননি। জিয়াউর রহমানের এই ভূমিকার কথা জানতেন তার সহকর্মী লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলীও। তিনি লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার থাকাকালে আমার কাছে কিছু কিছু কথা বলেছেনও। চাকরি ছাড়ার পর তার আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার ইচ্ছা ছিল। তিনি চেষ্টা করেও পারেননি। ফলে বিএনপিতে যোগ দেন। জিয়াউর রহমানের গোপন কথা প্রকাশেরও সুযোগ তিনি পাননি। তার অকাল প্রয়াণ ঘটে। এই জিয়াউর রহমানের পুত্র এখন বিদেশে বসে গণতন্ত্রী সেজেছেন। নতুন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিচ্ছেন। পিতার মতো চশমায় চোখ ঢেকে রংমশালী রাজনীতি শুরু করেছেন। নিজের অতীতের দুষ্কর্মের জন্য দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা না চেয়ে তারেক রহমানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কোন ভবিষ্যত আছে কি? লন্ডন ১০ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১৮
×