ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রাজীব

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১১ এপ্রিল ২০১৮

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রাজীব

গাফ্ফার খান চৌধুরী ॥ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুই বাসের ঘষায় ডান হাত হারানো ও মাথায় মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত তিতুমীর কলেজছাত্র রাজীব হোসেন। সোমবার দিবাগত রাত পৌনে চারটার দিকে হঠাৎ করেই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। নিশ্বাস নিতে পারছিল না। পরে চিকিৎসকরা দ্রুত রাজীবকে লাইফ সাপোর্ট দেয়। চিকিৎসা দিয়ে রাজিবকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তার খালা জানান। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা রাজীবের পরিবার। বিশেষ করে এতিম রাজীবের ছোট দুই ভাই রীতিমতো ভেঙ্গে পড়েছে। তারা রীতিমতো অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কা করছে। এদিকে রাজীবের দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্তের স্বার্থে বিআরটিসির দু’তলা বাসটি পুলিশ হেফাজতে নেয়ার আদেশ দিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। গত ৩ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে বাংলামোটর থেকে ফার্মগেটমুখী একটি দোতলা বিআরটিসি বাস কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশের সিগনালে থামে। একই দিক থেকে আসা স্বজন পরিবহনের একটি বাস দ্রুতগতিতে দোতলা বাসটির পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিআরটিসি বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের হাতসহ দুই বাসের প্রচ- ঘর্ষণ হয়। তাতেই রাজীবের হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে দু’তলা বাসের সঙ্গে ঝুঁলে থাকে। রাজীবকে দ্রুত পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসা চলছিল। রাজীবের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল। যোগাযোগ করা হলে রাজীবের মেজো খালা খাদিজা বেগম লিপি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে বলেন, সোমবার দিবাগত রাত পৌনে চারটার দিকে রাজিব নিশ্বাস নিতে পারছিল না। নিশ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এরপর দ্রুত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। চিকিৎসকরা রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়। চিকিৎসকরা বলেছেন, প্রায় সকল চিকিৎসাই ব্যর্থ হচ্ছে। তারা সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই রাজীবের উন্নতি হচ্ছে না। চিকিৎসায় রাজীবের আর সুস্থ হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। বাকিটা আল্লাহর হাতে। এরপর পরিবারের লোকজন ও রাজীবের দুই এতিম ছোট ভাই রীতিমতো ভেঙ্গে পড়েছে। তারা আর কথা বলতে পারছে না। অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কা করছে রাজীবের এতিম দুই ভাই। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে রীতিমতো কান্নার রোল পড়ে গেছে। কিছুতেই তারা সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না। রাজীবের সর্বশেষ পরিস্থিতি সর্ম্পকে মঙ্গলবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ শামসুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজীবের অবস্থা সোমবার দিবাগত রাতে হঠাৎ করেই মারাত্মক খারাপ হয়ে যায়। মাথায় মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে রাজীব। রাজীবের ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরেও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। এদিকে মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর হাকিম গোলাম নবী বিআরটিসির দু’তলা বাসটি হেফাজতে নেয়ার এবং দুইটি বাসের মালিকানা যাচাইবাছাই করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আফতাব আলীকে নির্দেশ দেন। এদিকে মঙ্গলবার বিআরটিসি বাসটির চালক ওয়াহিদ ও স্বজন পরিবহনের বাসটির চালক খোরশেদের জামিন শুনানির দিন আগামী ১৬ এপ্রিল ধার্য করেছেন ঢাকা মহানগর হাকিম আহসান হাবীব। রাজীবের খালা খাদিজা বেগম লিপি আরও জানান, রাজীবের পিতার নাম হেলাল উদ্দিন। অপসোনিন ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। অন্তত ৯ বছর আগে মারা যান। এর বছর পাঁচেক পরেই রাজিবের মা নাসিমা বেগম মারা যান। রাজীব মতিঝিলে খালার বাসায় থেকে পোস্টাল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। আর পুরান ঢাকায় অবস্থিত সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এরপর তিতুমীর সরকারী কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে পড়ছে। রাজীব টিউশনি করে এবং একটি কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করে পরিবার চালাত। পরিবার বলতে শুধু ছোট দুইটি ভাই। দুই ভাই যাত্রাবাড়ী তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় (এতিমখানা) পড়ছে। মেহেদী হাসান সপ্তম শ্রেণীতে আর হৃদয় হাসান আব্দুল্লাহ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। রাজীবের এমন অবস্থায় আমরা একেবারে দিশেহারা। ভবিষ্যতে অন্ধকার দেখছে রাজীবের দুই ভাই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইতোপূর্বে হাসপাতালে রাজীবকে দেখে তার যাবতীয় চিকিৎসা খরচ বহনের আশ্বাস দেন। রাজীব হোসেনের চিকিৎসা ব্যয় ওই দুই বাস মালিককে বহন করার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ হিসেবে এককোটি টাকা এবং রাজীবের কৃত্রিম হাত লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
×