ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেধা তালিকা অনুযায়ী সব সময়েই ৭০ ভাগের বেশি প্রার্থী চাকরি পায়

বর্তমান কোটা ব্যবস্থা নিরীক্ষা করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১০ এপ্রিল ২০১৮

বর্তমান কোটা ব্যবস্থা নিরীক্ষা করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

তপন বিশ্বাস ॥ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বর্তমান কোটাব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সংক্রান্ত একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও গণমাধ্যমে দেয়ার কথা বলেছেন তিনি। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী ও বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার সভাপতিত্বে ওই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। একাধিক মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, কোটা নিয়ে আন্দোলন করা দুঃখজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসির বাসভবনে ভাঙচুর করেছে শিক্ষার্থীরা। এ ধরনের ঘটনা পাকিস্তান আমলেও হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এসব কারা করছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কি চাকরির কোটা সংস্কার করতে পারবেন? এগুলো কেন করা হচ্ছে? আমাদের সংবিধানেই আছে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনার জন্য কোটা ব্যবস্থার কথা। সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে আলোচনা হয় যে, কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন মারা যাওয়ার গুজব ফেসবুকে ছড়িয়ে উসকানি দেয়া হয়েছে, যারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তারা এ আন্দোলনকে উসকে দিয়েছেন। কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। সর্বশেষ রবিবার তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগের সড়ক অবরোধ করে রাখেন। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। গভীর রাত পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলে। যে বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে বললেন প্রধানমন্ত্রী ॥ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে গত ৬ মার্চ কোটা সংক্রান্ত যে নির্দেশনা জারি করেছিল তাতে বলা হয়, সব সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার কোন পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হলে সেসব পদ মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের মধ্য হতে পূরণ করতে হবে। ৬ মার্চ জারি করা সরকারী আদেশের বিষয়ে ৫ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান স্বাক্ষরিত এক পরিপত্র জারি করা হয়। সেই পরিপত্রে কোটা বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ৫ এপ্রিল জারি হওয়া পরিপত্রে বলা হয় (ক) ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে, (১) ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বিষয়ে সরকারের গত ৫ মে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বিষয়ে সরকারের ২০১০ সালের ৫ মে জারি করা ১৫০নং পরিপত্র অনুসরণপূর্বক বিশেষ কোটার অধীন কোন জেলার বিতরণকৃত পদের সংখ্যা থেকে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা কম হলে উক্ত বিশেষ কোটার অপূর্ণ পদসমূহ জাতীয় ভিত্তিক স্ব স্ব বিশেষ কোটার (মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) জন্য প্রণীত জাতীয় মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। উক্ত সিদ্ধান্ত অনুসরণের পর সংশ্লিষ্ট নিয়োগের জন্য মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটার কোন কৃতকার্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে ওই পদগুলো অবশিষ্ট কোটা অর্থাৎ জেলার সাধারণ প্রার্থীদের থেকে পূরণ করা হবে। উপরোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করার পরও কোন বিশেষ কোটার বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পদ পূরণ করা সম্ভব না হলে অপূরণকৃত পদ জাতীয় মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের মধ্যে থেকে পূরণ করা হবে। জারি করা পরিপত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ কোটার অর্থাৎ এতিম ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং অনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্য কোন পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হলে সেইসব পদ জেলার সাধারণ কোটার প্রার্থীদের মধ্যে থেকে পূরণ করতে হবে। কিন্তু কোটার প্রার্থীর অভাবে শূন্য পদ রাখা যাবে না। সেটা মুক্তিযোদ্ধা কোটাই হোক বা অন্য কোটাই হোক পদ খালি রাখা হবে না। এছাড়া জারি করা আদেশে আরও বলা হয়েছে যে, কোটা সংক্রান্ত বিদ্যমান অন্যান্য বিধান অপরিবর্তিত থাকবে। সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বিভিন্ন কর্পোরেশন ও দফতরের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে এই পরিপত্রের আদেশ কার্যকর হবে। কোটার কারণে কোন মেধাবী কখনই বঞ্চিত হয়নি। কোটা সংস্কারের বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোন আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কোটা নিয়ে আসলে তো কোন সমস্যা নেই। এখন যে কোটাব্যবস্থা রয়েছে সেখানে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোটা ৫ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা বা অন্যান্য কোটাগুলো যদি পূরণ করা সম্ভব না হয় তবে ওইসব পদসমূহ জাতীয় মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হবে। সেটা পূরণ করা হয়েছেও। ৩৩তম বিসিএসে মেধাকোটায় পূর্ণ হয়েছে ৭৭ দশমিক ৪০ শতাংশ, ৩৫তম বিসিএসে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ মেধা তালিকা থেকে এসেছে। ৩৬তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ মেধাকোটায় নিয়োগ পেয়েছেন বলেও জানান শফিউল আলম। তিনি বলেন, কোটার মাধ্যমে মেধা অবহেলিত হয়নি। কোটার ক্ষেত্রেও যারা মেধাতালিকায় ভাল তারা আসছেন। এমন না যে মেধাতালিকায় যারা আছেন তারা অবহেলিত আছেন, পেছনে পড়ে যাচ্ছেন। কোটার দ্বারা কারও মেধা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বিভিন্ন কোটায় প্রার্থী পাওয়া যায় না, তাহলে কোটা সংস্কারে সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকার শীর্ষে যারা আছেন তাদের দিয়ে পূরণ করা হবে। এটাই তো একটা সংস্কার। সচিব বলেন, কোটা হচ্ছে একটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এর মাধ্যমে অনগ্রসর যারা আছেন তাদের সামনে আনা হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোটার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যা আলোচনা হয়েছে তা জানিয়েছি তো। কোটার কারণে যারা মেধাবী তারা খুব বেশি বঞ্চিত হয়নি। আপনাদের তো তিনটা বিসিএসের রেজাল্ট দিয়ে দিলাম। কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে তা পূরণের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভা দিলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদের ক্ষেত্রে কোন কোটা পূরণ না হলে অন্যান্য কোটা দিয়ে পূরণ করতে হবে। এ জন্য আন্দোলন হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশটি আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। কোট সংস্কারের বিষয়ে আজকের (সোমবারের) মন্ত্রিসভা বৈঠকে কোন সিদ্ধান্ত হয়েছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে শফিউল আলম বলেন, না আজকে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় আছে। অনির্ধারিত আলোচনা তো এ রকম অনেক কিছু হয়ই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হলো এটার স্টেক হোল্ডার। তারা এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। দেখে অবহিত করবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পরীক্ষার-নিরীক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ ক্ষেত্রে তিনি কোন নির্দেশনা দিয়েছেন কি না- জানতে চাইলে শফিউল আলম বলেন, ইনফরমাল আলোচনা তো, ইনফরমালভাবেই ধরে নিতে হয়। কোটা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সোমবার জনপ্রশাস মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংস্কারের কোন পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। কোটা পূরণ না হলে মেধাতালিকার শীর্ষ থেকে নেয়া হবে। কোটা নিয়ে ১৪ দিনের প্রতিক্রিয়া ॥ এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সোমবার বিকেলে কোটা সংস্কারের নামে আন্দোলন এক ধরনের নৈরাজ্য বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এই নৈরাজ্য সহ্য করা হবে না। যে কোন দাবি নিয়ে আন্দোলন করা যেতে পারে। তবে কোন সহিংসতা সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা এর নিন্দা জানাই। সোমবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে তিনি এ সব কথা বলেন। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমরা যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করি, কিন্তু গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে থামিয়ে দিতে এ ধরনের সহিংসতাকে পছন্দ করি না। কেউ যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ১৪ দলের সমন্বয়ক আরও বলেন, দাবি আদায়ের নামে নিরীহ ছাত্রদের লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিজেরা আন্দোলন করতে না পেরে তারা ছাত্রদের লেলিয়ে দিচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কোটা সংস্কার সরকারের কাজ। কিন্তু এ দাবিতে ভিসির বাড়িতে হামলা অন্য অর্থ বহন করে। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের ওয়াজেদুল ইসলাম খান, অসিত বরুণ রায়, ন্যাপ নেতা ইসমাইল হোসেনসহ অনেকে।
×