ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভেতরে তারা নির্বাচনমুখী

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১০ এপ্রিল ২০১৮

ভেতরে তারা নির্বাচনমুখী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতি শোনা গেলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। বিএনপি একেক সময়ে একেক নেতার বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে কিছুটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করলেও তাদের সিনিয়র নেতাদের মাঝে কেউ কেউ বলেছেন- ‘নির্বাচনে যাবে তবে, কিছু শর্ত মানা হলে’। আবার কিছু নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না বলেও আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অন্যদিকে কিছু নেতা আবার সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। তবে যেভাবেই বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে মাঠ গোছানোর কাজ ঠিকই করছেন তারা। কেন্দ্র থেকে মাঠের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছেন। তবে এটা বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার আগের প্রেক্ষাপট। এখন বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ একটু ভিন্ন মাত্রার হিসাব নিয়ে এগুচ্ছে। খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না এমন বক্তব্য কিছু সিনিয়র নেতাদের মুখে শোনা গেলেও এখন ক্ষেত্র বিশেষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তারা। অনেকেই বলেন, বিএনপি কয়েক ভাগে বিভক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই বিএনপি আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এটা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়। অতীতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্ত থাকলেও এখনকার প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। ইতোমধ্যেই তারেক জিয়াকে বাইরে রেখে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। খালেদা জিয়াও কারাগারে। হাইকোর্ট থেকে চার মাসের জামিন পেলেও আপিল বিভাগ আটকে দিয়েছে। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ায় আইনী জটিলতা রয়েছে। বিচারের অপেক্ষমাণ আরও ৩৫টি মামলা। এখন সময়ের কারণে অনেক কিছুর দৃশ্যই অপেক্ষমাণ। তবে জুনিয়র কিছু নেতার কারণে হয়ত কিছু সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসতে পারে। কারণ, তারেক জিয়ার অত্যাচার, নির্যাতন যে সকল নেতাকর্মী সহ্য করেনি তারা এখনও তার আনুগত্য প্রকাশ করছে, তাও প্রকাশ্যে এবং একান্ত মিটিংগুলোতে। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায়, পাঁচ বছরের সাজা এবং দলের গঠনতন্ত্রের ৭ অনুচ্ছেদের (ক)-এর উপধারা পরিবর্তন নিয়েও দলের ভেতরে-বাইরে নানামুখী সমালোচনায় বিএনপির নেতাকর্মী বিব্রত। অনেকে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও চা-এর টেবিলে ঠিকই কথাগুলো প্রকাশ করে থাকে। আবার বিএনপি যে জিয়াউর রহমানের আদর্শে নেই সেটিও দলের কিছু নেতা-কর্মী আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তু করছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু ব্যক্তির কারণে, বলা যেতে পারে কারও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মা-ছেলে অর্থাৎ খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার কারণে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির হাজার-হাজার নেতা-কর্মী অসহায় হয়ে পড়ে। তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা সবাই নির্বাচনমুখী হয়ে শুধু নিদের্শনার অপেক্ষায় ছিল। অনেকে দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেও কেন্দ্রীয় কিছু আস্থাভাজন নেতাদের পরামর্শে সেখান থেকে ফিরে আসে। তবে শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিল খালেদা জিয়ার নির্দেশনার। এবার আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মীর পরিকল্পনা একেবারেই ভিন্ন। অনেকেই নিবন্ধিত অনেক দলের সঙ্গে রীতিমতো দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত এক প্রকার নিয়ে রেখেছে। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রায় ৪০টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন চূড়ান্তভাবে প্রকাশও পেয়েছে। সামনে আরও নিবন্ধন দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনাধীন। তবে সূক্ষ্ম একটি গ্রুপিং করে বিএনপির বৃহৎ একটি অংশ বিভিন্ন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলে নিজেদের নাম লিখিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এদিকে আবার জাতীয় পার্টি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দলেও বিএনপির একটি বৃহৎ অংশ যোগদানের খবর প্রকাশ পেয়েছে। যা হোক, বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরে রাখার চেয়ে এখন বড় সমস্যাটি হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে দল হিসাবে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করবে নির্বাচন কমিশন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিরোধী দলের স্ট্যাটাস থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা। বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে বিরোধী দলের স্ট্যাটাস নিয়ে বসতে না পারা, অধিকার রেখে কথা না বলার যন্ত্রণা বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ততটা অনুধাবন করতে না পারলেও তার দলের সিনিয়র নেতারা ঠিকই মনে-মনে জ্বলছে। কষ্টগুলো মুখ খুলে বলতে না পেরে রীতিমতো বুকে পাথর চেপে সহ্য করছে। সেই অর্থে দেশে রাজনীতি করার আগ্রহ, নেতাকর্মীদের ছন্দহীন মিছিল-মিটিং তাদের অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হতে হয়েছে, হচ্ছে। নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দলের আলোচনা সভা, মানববন্ধন করা, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দিবসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা-সম্মান জানানো, সরকারের ভুলের প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকারটুকু এবার নষ্ট করতে আগ্রহী নন বিএনপির সিনিয়র নেতাকর্মীরা। তাই কৌশল নিয়ে মাঠের রাজনীতি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপির একদল নেতা-কর্মীর বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে আবার আরেক দলের দাবি- সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে বিএনপি সেখানে অংশগ্রহণ করবে। এ নিয়ে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সাম্প্রতিক ইতালি সফর শেষ করে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছে, পারেনি। এবারও পারবে না। জনগণের ওপর যে দলের আস্থা আছে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে আমাদের কিছুই করণীয় নেই।’ শেখ হাসিনার কথার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে এবারও ছাড় দেবে না মর্মে তার আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন বিএনপির একদল সিনিয়র নেতা। এটাই যে শেখ হাসিনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারা মিটিং করেও একমত হয়েছেন। ওই বৈঠকে দশম জাতীয় সংসদ নিয়েও আলোচনা হয় এবং সে নির্বাচনকালীন পরবর্তী সরকারকে কীভাবে টেনে ৫ বছর তার মেয়াদ পূর্ণ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আনতে সফলতা অর্জন করেছে, সে বিষয়ের উপরও আলোকপাত করা হয়। অধিকাংশ নেতাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। আর এবারও যে তিনি কোন ছাড় দেবেন না, তাও প্রায় নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছে। কারণ ইতোমধ্যেই আইনী কাঠামোর মধ্যে শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে খালেদা জিয়ার বাড়ি গেল। বিচারের মাধ্যমে মওদুদও তার বাড়ি হারাল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাইরে রেখে বিরোধী দলের স্ট্যাটাস কেড়ে নিল। এবার যদি দলের নিবন্ধনও হাত ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে পুরো রাজনীতির মাঠই আওয়ামী লীগের একক দখলে চলে যাবে। হাসতে-হাসতে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেই ফেলেছেন, মা-ছেলের কথা শুনলে (খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া) একটা সময় বিএনপিও জেএমবির মতন নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এখানে বিএনপির অনেক নেতাই পেট্রোল বোমায় মানুষকে পুড়িয়ে মারার কৌশলটা মানতে পারেনি, এখনও পারছে না। খালেদার বাড়ির গেটের সামনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার ঔদ্ধত্য; রাজনৈতিক অজ্ঞতাকেই দায়ী করে। আবার এই ঘটনার জন্য খালেদা জিয়াকে সার্বক্ষণিক ঘিরে রাখা কতিপয় নেতা-কর্মীর ওপর দোষের আঙ্গুল গর্জে উঠে। আর এসব কারণেই সরকারের অনেক ভুলের বিরুদ্ধে জনগণকে নিজেদের কাছে টানতে পারেনি বলে বিএনপির অনেক নেতার অভিমত। এমনকি খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়া হবে এই বার্তা দিয়ে মাঠের রাজনীতিকেও চাঙ্গা করতে পারেনি। আবার বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মীসহ দেশের জনগণকে মাঠে নামানো সম্ভব হয়নি। কেউ তেমন কোন গুরুত্ব দেয়নি, প্রতিবাদ করেনি। দুই. এখন আর তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকার নয়। শুধু খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না কৌশল নিয়ে বিএনপির একদল সিনিয়র নেতারা কাজ করছে। এখানে সূক্ষ্মভাবে তারেক জিয়াকে ফেলে দেয়ার একটা কৌশলও সময়ের কারণে গৃহীত হয়েছে। দেখবেন, এখনকার বক্তব্য- বিবৃতিগুলোতে তারেক জিয়ার নাম আর তেমন শোনা যায় না। সবাই খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এটাও যে খুব জোরালো, তাও কিন্তু নয়। বরং অনেক নেতাই এতে বড্ড খুশি। বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাসহ তৃণমূল পর্যন্ত জামায়াত ইসলামকে জোটে রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। আবার রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে জামায়াত ও পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাজ করা নিয়ে দলের ভেতর অনেক সমালোচনাও হয়েছে। এ সবই খালেদা জিয়ার অন্তড়ালে। এবার খালেদা জিয়া ইচ্ছে করলেও খুব সহসা বের হতে পারবেন না। একের পর এক আইনী জটিলতা, পাহাড় সমান মামলা এবং কারাগারে থাকা অবস্থায় অনেকগুলো মামলার আসন্ন রায় নিয়ে যে খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে আবারও রাজনৈতিক মাঠ চষে বেড়াবে, সেটার আশাও ক্ষীণ। তাই মাঠে-ময়দানে খালেদা জিয়ার মুক্তির একদফা আন্দোলন হলেও নেপথ্যে বিএনপি এখন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত অবস্থায় আছে। ভেতরে ভেতরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত গ্রুপের সিনিয়র নেতাদের অনুসারী ঢাকার নেতা-কর্মীসহ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে ইতোমধ্যেই একান্ত বার্তা পৌঁছে গেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতিও গ্রহণ করার কৌশল নেয়া হয়েছে। এখানে একদিকে দৃশ্যমান খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন হবে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে না মর্মে সংবাদ শিরোনাম করার অন্তড়ালে দলীয় কৌশল নির্ধারণ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতির কাজও সমানতালে এগিয়ে নিচ্ছে। তাই বলা যায়, ভেতরে ভেতরে বিএনপি নির্বাচনমুখী হচ্ছে। লেখক : সভাপতি, বোয়াফ
×