ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এত বড় অর্জনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা!

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১০ এপ্রিল ২০১৮

এত বড় অর্জনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা!

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর পর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এবং প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশেষ জায়গা করে নিতে শুরু করেছে, যার প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে। এই অর্জনের সকল কৃতিত্ব দেশের আপামর জনগণের, এতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই দেশের অর্থনীতি আজ এ পর্যায়ে উপনীত হতে পেরেছে। তবে, যে কোন সফলতা বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক নেতৃত্বের। আর এই সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা এজন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ। সমগ্র বাঙালী জাতি যে দু’জন ব্যক্তির নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকবে, তাদের একজন হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দ্বিতীয়জন হলেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সংগ্রাম করে চরম ত্যাগ স্বীকার করে বাঙালী জাতির জন্য এনে দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন দেশ। আজ আমাদের মতো অসংখ্য বাংলাদেশী যে উন্নত বিশ্বে এসে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বিভিন্ন চাকরি করছি, সেটা তো দূরের কথা, এমনকি দেশে একটি কেরানীর চাকরিও করতে পারতাম না যদি না বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র দিয়ে না যেতেন। একইভাবে যে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারসহ পশ্চিমা বিশ্ব ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল, সেই বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায় পৌঁছে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বা খাট করতে অনেকেই বলতে চাইছেন যে, একটি দেশের অর্থনীতি সময়ের আবর্তে এমনিতেই এগিয়ে যায়। দুর্মুখ জ্ঞানপাপী আর কাকে বলে! এই ধরণের দৃশ্যমান উন্নতি কখনই এমনি এমনি হয় না। এজন্য প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব যিনি যথাযথভাবে অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। অর্থনীতির এই কাজটি করতে হয় বেশ কিছুটা সময় ধরে অথচ ফলটা আসে একটা পর্যায় গিয়ে। আর এই কাজটিই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং যথেষ্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। শুধু তাই নয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, মেট্রো রেল নির্মাণ, চার লেনের সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করাসহ এমন সব মেগা প্রকল্প একের পর এক গৃহীত এবং বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে, তা শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোন নেতা-নেত্রীর পক্ষে যে সম্ভব হতো না একথা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। অনেকেই তো দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নজির তারা দেখাতে পারবেন না। দেশকে সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযুক্ত করার মতো সামান্যতম সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারেন না, তারা দেশকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাবেন এমনটা টেলিভিশনের টকশোর চাপাবাজি হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সম্ভব নয়। এখানেই শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি এবং সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা। আর এ কারণেই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে উচ্চৈঃস্বরে। উন্নত বিশ্বের দু’একটি পেশাদার (প্রফেশনাল) সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আমাকে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সেমিনার বা আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। এসব অনুষ্ঠানে যখন দেখি অর্থনৈতিক উন্নতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাফল্য এবং যোগ্য নেতৃত্ব শেখ হাসিনার নাম উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তখন নিজেকে ধন্য মনে করি এবং গর্বে বুকটা ভড়ে যায়। এখানেও যে দু’জন বাংলাদেশী রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম বেশ উচ্চৈঃস্বরে প্রশংসিত হয়ে থাকে, তারা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, দেশের এত বড় সাফল্যও যেন অনেকেই মানতে পারছেন না। যেহেতু স্বীকার না করে উপায় নেই, তাই অনেকের কিছুটা বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে গিয়ে মনে হয় যেন কষ্টে বুক ফেটে যায়। অনেকে তো এই সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে বলার চেষ্টা করছেন যে, উন্নয়ন হলেও এতে দেশের মানুষের কোন লাভ হয়নি, কেননা মানুষের আয় বৈষম্য বেড়েছে। রাজনীতিবিদদের কথা ভিন্ন, কারণ তারা সমালোচনার স্বার্থে যে কোন অর্জনের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে। এটাই আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু যখন তথাকথিত শিক্ষিত এবং পেশাদার বলে দাবিদার কিছু লোকজন এমন মন্তব্য করেন, তখন খুবই দুঃখ হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল কথাই তো আয় বৈষম্য সৃষ্টি করা। কেননা সীমিত সম্পদ একদিক থেকে শোষণ করে অন্যদিকে পুঞ্জীভূত করাই তো পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা তো দাঁড়াতে পারেনি এবং পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে মেনে নিতে হয়েছে। আর পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মেনে নিলে, আয় বৈষম্যকেও মেনে নিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে তো তবুও এই আয় বৈষম্য তুলনামূলক অনেক কম। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা অনেক স্পষ্ট হবে। উন্নত বিশ্বে একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর বার্ষিক বেতন যদি হয় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার বার্ষিক বেতন মাত্র পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার। অর্থাৎ একজন কর্মকর্তার বেতন সেই কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর বেতনের মাত্র শূন্য দশমিক চার শতাংশ (০.৪%)। অথচ আমাদের দেশের একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর মাসিক বেতন যদি হয় আট লক্ষ টাকা, সেই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার মাসিক বেতন হয়ে থাকে ত্রিশ হাজার টাকা। অর্থাৎ আমাদের দেশের একটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার বেতন সেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর বেতনের পাঁচ শতাংশ (৫%)। শুধু তাই নয় আমাদের দেশে আয় বুঝে ব্যয় করার যথেষ্ট সুযোগ থাকায় যে কেউ তার প্রকৃত আয় হ্রাসবৃদ্ধি করতে পারে। অথচ উন্নত বিশ্বে আয় বুঝে ব্যয় করার তেমন কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। অর্থাৎ এই উন্নত বিশ্বে থাকতে হলে আয় উপার্জন যাই হোক না কেন এবং অর্থের জোগান যেখান থেকেই আসুক না কেন, জীবনযাত্রা নির্বাহ করার জন্য প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেই হবে। ফলে এখানে জীবনযাপনের জন্য মানুষকে প্রতিনিয়ত ক্রেডিট কার্ড বা ব্যক্তিগত ঋণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভর করতে হয়। আর এ কারণে উন্নত বিশ্বে বাড়ির মর্টগেজ ঋণ ছাড়াই মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ মানুষের উপার্জনের দেরগুণ বা তার অধিক। অর্থাৎ কারও উপার্জন যদি হয় পঞ্চাশ হাজার ডলার তাহলে তার গড় ঋণের পরিমাণ হবে পঁচাত্তর হাজার ডলার, যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কল্পনাই করা যায় না। এসব উন্নত বিশ্বের যদি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হয় বা ক্রেডিট কার্ডের ঋণ পরিশোধ করতে বলা হয়, তাহলে এসব উন্নত অর্থনীতি শুধু যে মুখ থুবড়ে পড়বে তাই নয়, পুরো দেশও দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। আমার এমন মন্তব্যকে অনেকেই অতিরঞ্জিত ভাবতে পারেন, তবে এখন আমাদের দেশের অনেকেরই পরিচিত কেউ না কেউ এসব উন্নত দেশে বসবাস করছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেই আমার কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এই সাফল্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যে অপপ্রচার চালিয়ে অনেকেই বলছেন যে, এতে দেশের অনেক ক্ষতি হবে। সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যাবে না, নানাবিধ বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়া যাবে না ইত্যাদি নানান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার চেষ্টাও তারা করছেন। যুক্তিবাদীর কুযুক্তি আর কাকে বলে! কারও পদোন্নতি হলে বা বেতন বৃদ্ধি পেলে বেশি করে আয়কর দিতে হবে সে কথা সবাই জানে। তাই বলে কি কেউ পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধির চেষ্টা করবে না। শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করার মতো মানসিকতাসম্পন্ন এমন মতলববাজ কূপমণ্ডূকদের একমাত্র আমাদের দেশেই থাকা সম্ভব। একটি কথা সকলেরই জানা প্রয়োজন যে, বিশ্ব অর্থনীতি এখন যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে গত শতকের আশির দশকের মতো ঢালাও বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য এমনিতেই আর পাওয়া যাবে না। তাছাড়া উন্নত বিশ্বে যারা সাধারণত সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে তারা নিজেরাই এখন নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অন্যদের সাহায্য সহযোগিতা করবে কিভাবে। বাংলাদেশ এখন যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে বৈদেশিক সাহায্যের আর তেমন প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারলে বাংলাদেশ এখন দেশীয় এবং বৈদেশিক উভয় মুদ্রায় পর্যাপ্ত অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে পারবে, যা দিয়ে খুব সহজেই অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ চাহিদা মিটানো সম্ভব। এটা কিভাবে সম্ভব সেটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং বিস্তারিত আলোচনার বিষয় তাই এ ব্যাপারে ভিন্ন পরিসরে লেখার ইচ্ছে রইল। আর পণ্য রফতানি, সেটিও কারও দয়ায় হবে না। বাংলাদেশ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বল্প মূল্যে নির্দিষ্ট মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত রফতানি অবারিত থাকবে। কেননা উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ীরা মূলত বেনিয়ার জাত, তাই তারা মুখে যতই কমপ্লায়েন্সের বা নিয়মনীতির কথা বলুক না কেন, যেখান থেকে সস্তায় পণ্য পাবে সেখান থেকেই তারা আমদানি করবে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের দেশের উৎপাদনকারী এবং রফতানিকারকদের পণ্য উৎপাদন ও রফতানি কৌশল নির্ধারণ করা উচিত। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে উন্নিত হয়েছে এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি বৃহৎ অর্জন। আর, এত বড় অর্জন গুটিকয়েক বিতর্কিত লোকের নেতিবাচক সমালোচনায় ম্লান হয়ে যাবে না। এ কথাও বাস্তব সত্য। লেখক : ব্যাংকার, টরেন্টো, কানাডা [email protected]
×