ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বার ও বেঞ্চের সমন্বয়

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১০ এপ্রিল ২০১৮

বার ও বেঞ্চের সমন্বয়

বার কাউন্সিলে নতুন অন্তর্ভুক্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার নতুন আইনজীবীর হাতে সনদ তুলে দেয়ার এক অনুষ্ঠানে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি বার ও বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, বার ও বেঞ্চ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একে অপরের পরিপূরক হয়ে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হবে। বার ও বেঞ্চের নৈতিক ভিত্তি যাতে ধ্বংস না হয় সে বিষয়েও সবাইকে সচেষ্ট থাকতে বলেছেন তিনি। এর পাশাপাশি যুক্তিসঙ্গত, আনুগত্যপূর্ণ ও সুষম সম্পর্ক বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে সেই পরিবেশ ও বদান্যতা অনেকাংশে অনুপস্থিত। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে নানা অস্থিরতা ও জটিলতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। রাজনীতি ও দলীয়করণের কারণে বিচারাঙ্গনের ভাবমূর্তি হয়েছে বিতর্কিত। সময়ে সময়ে বার ও বেঞ্চের সম্পর্ক হয়েছে অম্লমধুর। এমনকি রাষ্ট্র ও আইনসভার সঙ্গেও সর্বোচ্চ আদালতের টানাপোড়েন লক্ষ্য করা গেছে। অথচ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সর্বদাই সরকারের নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা পোষণ, সমন্বয় সাধন সর্বোপরি আস্থা ও সমঝোতার মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে বিগত প্রধান বিচারপতি বর্তমানে স্বেচ্ছা নির্বাসিত এসকে সিনহার আমলে এই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা কখনই কাম্য ছিল না। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির আমলে এহেন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির অবসান হবে বলে আশা করা যায়। সে ক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চের সমন্বয় সাধন জরুরী ও অত্যাবশ্যক। একই অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমানে হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগে প্রায় পাঁচ লাখ মামলা বিচারাধীন। অথচ আপীল বিভাগে চার এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৮০ জন বিচারপতি রয়েছেন। যে পরিমাণ মামলা রয়েছে তা নিষ্পত্তি করতে দ্রুত বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এর জন্য আইনের খসড়াও চূড়ান্ত হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যেই যা উপস্থাপন করা হবে মন্ত্রিপরিষদে। এটিও নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ইতোপূর্বে অধিষ্ঠিত ২১তম প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সর্বোচ্চ বিচারালয়কে কলুষিত করে রেখে গেছেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের নথি উপস্থাপিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। তদন্তাধীন কোন বিষয়ে মন্তব্য করা বাঞ্ছনীয় নয়। তবে এটা তো সত্যি যে, সর্বস্তরের মানুষের শেষ ভরসাস্থল হলো আদালত। মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় দ্বারস্থ হয়ে থাকে আদালতের। সে ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার এমনকি নৈতিক স্খলনও একজন বিচারকের কাছে কাম্য নয়, প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে তো নয়ই। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, বিগত প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। এর বাইরেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন সময়ে তিনি নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা আইনজীবী ও জনমনে ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায়ের প্রাক্কালে কুখ্যাত সাকা চৌধুরীর স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতদান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর, যা তিনি নিজেও প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। আশা করি, তিনি ‘সুস্থ’ হয়ে দেশে ফিরে আসবেন এবং তার বিরুদ্ধে আনীত তদন্তাধীন বিষয়গুলো মোকাবেলা করবেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষাসহ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার স্বার্থে সেটাই প্রত্যাশিত। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বর্তমান প্রধান বিচারপতি নিয়োগ আদালত প্রাঙ্গণসহ সরকার ও বিরোধী পক্ষ একবাক্যে মেনে নিয়েছেন। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করব যে, সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে তিনি সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করবেন। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বস্তরে সর্বত্র স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা রক্ষা করা অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে বার ও বেঞ্চের সমন্বয়সহ রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে আস্থা ও পারস্পরিক সহাবস্থানের সম্পর্কও জরুরী।
×