ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টিয়ারশেল নিক্ষেপ, ফাঁকা গুলি ॥ সাংবাদিকসহ কয়েকজন আহত

কোটা সংস্কার দাবিতে সড়ক অবরোধ ॥ শাহবাগ রণক্ষেত্র

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ৯ এপ্রিল ২০১৮

কোটা সংস্কার দাবিতে সড়ক অবরোধ ॥ শাহবাগ রণক্ষেত্র

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারী চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। রবিবার রাতে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়লে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় শাহবাগ এলাকা। এ সময় পুলিশ কয়েকজন সাংবাদিককে লাঠিপেটা করে। টিয়ারশেলে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান। এদিকে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে গণপদযাত্রা কর্মসূচী পালন করেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক এবং ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে ওইসব মহাসড়কে যান চলাচল কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে। এতে ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা। কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীদের ওপর একের পর এক কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে পুলিশ। রবিবার রাত সোয়া দশটা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় পুলিশ জলকামান ব্যবহার এবং লাঠিপেটাও করে। আন্দোলনকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এর আগে রাত পৌনে আটটার দিকে পুলিশ বিক্ষোভাকারীদের লাঠিপেটা করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা পিছু হটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে অবস্থান নেন। অন্যদিকে পুলিশ চারুকলার সামনে অবস্থান নেয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। টিএসসি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত পুরো এলাকা কাঁদানে গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এ থেকে রক্ষা পেতে আন্দোলনকারীরা সড়কের ওপর আগুন জ্বালায়। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। কয়েকজন আন্দোলনকারী ও পথচারী আহত হন বলে জানা গেছে। তিন পুলিশ সদস্যও আহত হয়। এর আগে দুপুর আড়াইটার দিকে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রত্যাশীরা। এ সময় শাহবাগ গোলচত্বর ও পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে শত শত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। এতে শাহবাগ মোড়, আজিজ সুপার মার্কেটের সামনের রাস্তা, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, বাংলামোটর থেকে শাহবাগ মোড়সহ আশপাশে এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল ও সোনারগাঁও রোডে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ শাহবাগের আগে পরীবাগের রোড দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে যানজট নিরসনের চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে মৎস্য ভবন চৌরাস্তার অভিমুখে পুলিশ শাহবাগমুখী যানবাহন ঘুরিয়ে দেয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা। শাহবাগ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় যানবাহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল। পরে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনরত শত শত শিক্ষার্থী শাহবাগ চৌরাস্তায় শুয়ে বসে পড়ে। এ সময় স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে শাহবাগ। আন্দোলনরতরা জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না দিলে শাহবাগের রাস্তা না ছাড়ার ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেছেন, আমরা চাই এ মুহূর্তে চলা সংসদের অধিবেশনে সরকার বিষয়টি সমাধানের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেবে। নতুবা অবরোধ চলবে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জানান, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে এক বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোনভাবেই হচ্ছে না। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়কার বাস্তবতা বিবেচনায় ৫৬ শতাংশ কোটা রেখেছিলেন। তবে এখন আর এত কোটার প্রয়োজন নেই। সরকার এটাকে বহাল রেখে মেধাবীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করছে। আমাদের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না দেয়া হলে আমরা রাজপথ ছাড়ব না। বেলা আড়াইটা থেকে শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে রাখে আন্দোলনকারীরা। চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত না করে যৌক্তিক সংস্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন তারা। দাবিগুলো হচ্ছে, কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ থেকে ১০ ভাগে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্যপদে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দেয়া, কোটায় কোন ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেয়া, সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে যুগ্ম আহ্বায়ক মোঃ উজ্জ্বল মিয়া জানান, সংসদ অধিবেশন চলছে এখন, আমরা চাই এই অধিবেশন থেকেই ঘোষণা দেয়া হোক কোটা পদ্ধতি সংস্কারের। যদি ঘোষণা না দেয়া হয় তাহলে উঠব না। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খানের কুশপুতুল দাহ করেন আন্দোলনকারীরা। উজ্জ্বল জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোটায় শূন্য থাকা সিটে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হবে। সেখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, এক কোটার শূন্য আসন অন্য কোটা দিয়ে পূরণ করা হবে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এদিকে শত শত শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা শাহবাগ মোড়ে জড়ো হওয়ার পর পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নেয়। এর আগে দুপুর দেড়টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিলে মিছিলে কর্মসূচীস্থলে আসতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের পদযাত্রা শুরু করে। পরে রাজু ভাস্কর্য হয়ে নীলক্ষেত ও কাঁটাবন ঘুরে পদযাত্রাটি শাহবাগ মোড়ে আসে। এরপর দুপুর আড়াইটা থেকে সেখানেই অবস্থান করে তারা। তাদের দাবি কোটা বিলুপ্ত নয়, যৌক্তিক সংস্কার করা হোক। মিছিল থেকে আন্দোলনরতরা বিভিন্ন স্লোগান দেয়। এ সময় শাহবাগ পুলিশ বক্সের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ লাঠিসোঁটা, টিয়ারশেল নিয়ে অবস্থান নেয়। শাহবাগ থানার সামনে একটি সাঁজোয়া যান (এপিসি) প্রস্তুত রাখা হয়। শাহবাগ থানা থেকে সাঁজোয়া যান বের করা হলে সাঁজোয়া যানের সামনে শুয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। সাঁজোয়া যানের সামনে বুক পেতে দেন তারা। পরে পুলিশ সাঁজোয়া যান পেছনে নিতে বাধ্য হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী উপ-কমিশনার (এডিসি) আজিমুল হক ‘জনদুর্ভোগ’ সৃষ্টি না করে সরে যেতে বললেও বিক্ষোভকারীরা অনড় থাকে। এ সময় বেশ কয়েকজন হাতে গোলাপ নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলে এক পর্যায়ে পুলিশ বাধ্য হয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ জানান, বর্তমান কোটা ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন দেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে। এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা সেখানেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ ॥ কোটা সংস্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রবিবার বিকেল সোয়া পাঁচটা থেকে এ অবরোধ শুরু হয়ে চলে রাত পর্যন্ত। অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয় দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়ে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ ॥ কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ময়মনসিংহে রবিবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা বই-খাতা মহাসড়কের ওপর রেখে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। কমপক্ষে তিন ঘণ্টা মহাসড়কটি অবরোধ করে রাখা হয়। তবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ সময় তারা ‘সরকারী আমলার’ কুশপুতুল দাহ করেন।
×