ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈশাখ বরণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় নাখোশ সংস্কৃতিকর্মীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ এপ্রিল ২০১৮

বৈশাখ বরণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় নাখোশ সংস্কৃতিকর্মীরা

মোরসালিন মিজান ॥ উন্মুক্ত স্থানে আয়োজিত পহেলা বৈশাখের সব উৎসব অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা খুশি হতে পারছেন না। বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা। স্বাধীনতার পক্ষের সরকার যখন ক্ষমতায় তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেছেন তারা। পহেলা বৈশাখ বাঙালীর শক্তি। সামাজিক এই অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ আরোপ করে শুভ শক্তিটিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মনে করছেন অনেকেই। জাতীয় ভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও হতাশ। বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা চূড়ান্ত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় উদার অসাম্প্রদায়িক জনগণকে ঘরে না ঢুকিয়ে ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আবহমান কাল ধরেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করে আসছে বাঙালী। ফসলকেন্দ্রিক প্রধান উৎসবটি একইসঙ্গে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে। নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার এই আয়োজন শহরেও বিপুল জনপ্রিয়। রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছরই অসংখ্য উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সব ধর্ম বর্ণ শ্রেণী-পেশার মানুষ এসব আয়োজনে অংশ নেন। একাত্ম হন। এবার ১৪২৫ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেবে বাঙালী। বছরের প্রথম দিনটি ঘিরে কত যে আবেগ উচ্ছ্বাস! সার্বজনীন উৎসবে এবারও যোগ দেবেন সবাই। রাজধানীর প্রতি প্রান্তেই কোন না কোন আয়োজন থাকবে। কিন্তু পহেলা বৈশাখের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন নিয়ে বরাবরই আপত্তি ছিল ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গীগোষ্ঠীর। দুই বছর আগে এসব হুমকি আমলে নিয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই ধরাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গম্ভীর মুখ করে তিনি জানিয়ে দেন, এবারও উন্মুক্ত স্থানে আয়োজিত পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার সময় মুখে মুখোশ পরা যাবে না। এবং একই সময় তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখে নিরাপত্তা বিঘœ ঘটানোর কোন ধরনের আশঙ্কা নেই। মন্ত্রীর স্ববিরোধী বক্তব্য সামনে আসার পর বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে অহর্নিশ থাকা মানুষেরা এই বক্তব্য মেনে নিতে রাজি নন। তারা বলছেন, কোন হুমকি নেই বলার পরও ‘ফতোয়া’ দিয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে। বাঙালী কখন কীভাবে কত সময় নববর্ষ উৎসব উদযাপন করবে সেটা নতুন করে বলে দেয়ার কিছু নেই। মৌলবাদীরা সব বন্ধ করে দিতে চায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন সংক্ষিপ্ত করতে। একই তো কথা হলো। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা ইস্যুটি সব সময়ই ছিল। তাই বলে পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবের লাগাম টানা নির্বুদ্ধিতা। পাঁচটার পরও অনুষ্ঠানমালা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান তারা। না দেয়া হলে সময় মতো তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ধরনের উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী শক্তিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয় বলে মনে করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এটি একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় নয়। পহেলা বৈশাখ কীভাবে কত সময় উদযাপন করা হবে তা রাষ্ট্র ঠিক করে দেয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই বাঙালী উৎসবটি উদযাপন করে আসছে। এখন রাষ্ট্র উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সেটা ভাল। কিন্তু এটিকে রাজনীতির জায়গা থেকে দেখলে চলবে না। জনগণের যে উদ্যাপন সেটি ছিনিয়ে না নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি। বলেন, নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। থাকবে। তাই বালির বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করা যাবে না। তারকাঁটার বেড়া দেয়া অনুচিত। যে জঙ্গীবাদ মৌলবাদের ভয় দেখানো হচ্ছে সেটি তো সব সময়ই কমবেশি ছিল। সরকার ওদের নিয়ন্ত্রণ করবে। আমাদের মুক্ত করবে। আমি আমার মতো উদযাপন করব। মৌলবাদীরা চায়, বাঙালী ঘরে বসে থাক। ওরা থাকবে মাঠে। এটা তো সরকার চাইতে পারে না। তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের মতো পহেলা বৈশাখেও লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আনন্দ করে। মুক্ত জীবনের, স্বাধীন সংস্কৃতির, পারস্পরিক সহমর্মিতার বোধ এভাবে জাগ্রত হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে এই সরকারকে গ্রহণ করেও আমি বলি, পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবের একটি স্বাভাবিক চেহারা আছে। সেটি অক্ষন্ন রাখতে দিন। একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালীর সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই উৎসব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ভাল ফল বয়ে আনবে না। বিকেল পাঁচটার পরও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময়ই তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। আমরাও সজাগ থাকব। এভাবেই সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। পহেলা বৈশাখের প্রধান আয়োজনটি ছায়ানটের। ভোরে রমনায় বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করবে বহু বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান। ছায়ানটের আয়োজন দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যাবে। তবে অন্য আয়োজনগুলো চলা উচিত বলে মনে করেন ছায়ানটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। সব বয়সী মানুষ প্রাণের টানে এদিন ছুটে আসেন। কিন্তু বাইরের সব অনুষ্ঠান পাঁচটার আগে বন্ধ হয়ে গেলে তারা কোথা যাবেন? এভাবে উৎসবটি ছোট না করে বড় করার, ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ পরা প্রসঙ্গে কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রাটি আমরা আয়োজন করি। তবে অগণিত মানুষের অংশগ্রহণে এটি সবার হয়ে ওঠে। এ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা মুখোশ পরেন না। অন্য অনেক কিছুর মতো মুখোশও হাতে বহন করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করেন। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানালেও তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এ দিকটি বিবেচনায় রাখার আহ্বান জানান তিনি। জাতীয় ভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও পাঁচটার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশে চরম অখুশি। অসন্তুষ্ট। অনেক সংগঠন পুলিশের নির্দেশনা মানতে নারাজ। সে কথা জানিয়ে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ঘোষণায় উৎসবমুখর বাঙালীর প্রাণের উচ্ছ্বাস দমন করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বিকাল পাঁচটার মধ্যে সব অনুষ্ঠান শেষ করার এ নির্দেশনা গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী প্রশ্রয় পাবে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বিষয়ক যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সার্বিকভাবে উৎসবের বৈচিত্র্যকে খর্ব করবে বলেও মনে করে উদীচী। এখানেই শেষ নয়, সিদ্ধান্তের বিপরীতে শুক্রবার দেশব্যাপী প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ করবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। শুক্রবার দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থিত উদীচী’র সাড়ে তিন শতাধিক শাখা সংসদের উদ্যোগে একযোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করা হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে ১৩ এপ্রিল শুক্রবার বিকেল ৪টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ কর্মসূচী আয়োজিত হবে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য হতাশ করলেও আশার বাণী শুনিয়েছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। দেশের খ্যাতিমান এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গত দুই বছর ধরে এ ব্যাপারে নিজের যুক্তি তুলে ধরছেন। এবারও নিজের অবস্থানে অনড় তিনি। মন্ত্রী ইতোমধ্যে পহেলা বৈশাখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে সব ধরনের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক আয়োজন বন্ধের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বিকাল পাঁচটার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণযোগ্য নয়। সংস্কৃতিকর্মীদের স্বাধীনতা দিতে হবে। সাধারণ মানুষও ভয় পায় না। তাদের অযথা ভয় দেখিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলে আমাদেরই ঠকতে হবে। নিজের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, মৌলবাদী জঙ্গীরা যে কোন দিন যে কোন জায়গায় ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করতে পারে। এ কারণে সব কিছু তো আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি না। মন্ত্রী বলেন, পহেলা বৈশাখে লাখ লাখ মানুষ বাসা থেকে বের হবে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে। তাদের কোন সমস্যা হলে পুলিশ কি দেখবে না? বরং অনুষ্ঠান হলে এক জায়গায় অনেক মানুষ সমবেত হন। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়া আরও সহজ হওয়ার কথা। সরকারের অবস্থান জানতে চাইল মন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তো বৈশাখে উৎসব ভাতা প্রদান করছে। মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলে ভাতা দিয়ে তারা কী করবে? মন্ত্রী বলেন, আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক বেশি সক্ষম। সারা বছর আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। বৈশাখেও পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী। সংস্কৃতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যই সরকারের বক্তব্য হবে বলে মনে করছেন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজকরা। জানা যায়, সেভাবেই অনুষ্ঠান সাজাচ্ছেন তারা। আর তা হলে পহেলা বৈশাখের আয়োজন সংক্ষিপ্ত হবে না। স্বতঃস্ফূর্ত জনগণই ঠিক করবে কত সময় ধরে চলবে অনুষ্ঠান।
×