ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিপণ্য অতিরিক্ত মজুদ করা হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ এপ্রিল ২০১৮

কৃষিপণ্য অতিরিক্ত মজুদ করা হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান আসছে

তপন বিশ্বাস ॥ ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী কৃষি উপকরণ ও কৃষিপণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত মজুদকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান করা হচ্ছে। বিশেষ করে বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যবসায়ী বা সরবরাহকারী কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণ গুদাম, ওয়্যারহাউস থেকে খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে অস¦ীকার করতে পারবেন না। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করলে এক বছরের কারাদ- এবং এক লাখ টাকা টাকা জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে। অপরাধ একই শাস্তি দুই বা ততোধিকবার করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে। এ জাতীয় বিধান রেখে কৃষিপণ্য বিপণন আইন ২০১৮ প্রণয়ন করছে সরকার। আইনটি ইতোমধ্যে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি অনুমোদন করেছে এবং ইতোমধ্যে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার এটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উত্থাপিত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, কৃষিপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে উৎপাদক ও ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশে ১৯২৮ সালে ‘রয়েল কমিশন অব এ্যাগ্রিকালচার’ গঠন করা হয়। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৩৪ সালে কৃষি বিপণন অধিদফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে কৃষিজাতপণ্য গুদামজাতকরণ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৫৯ সালে ওয়্যারহাউস অর্ডিন্যান্স এবং কৃষিপণ্যের ক্রয়বিক্রয় ও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৬৪ সালে ‘দ্য এ্যাগ্রিকালচার প্রোডাক্ট মার্কেটস রেগুলেশন এ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ আমলে বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১৯৮৫ সালে ‘দ্য এ্যাগ্রিকালচার প্রোডাক্ট মার্কেটস রেগুলেশন’ সংশোধন করা হয়। বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য উল্লিখিত আইন ও বিধিবিধান সমূহ ইংরেজী ভাষায় প্রণীত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ইংরেজী ভাষায় প্রণীত আইনসমূহ প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের এবং বাংলা ভাষায় প্রণয়নের জন্য ২০১৫ সালের ১ নবেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইংরেজী ভাষায় প্রণীত আইন ও বিধিসমূহ পরিবর্তন ও সংশোধনের পদক্ষেপ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এছাড়া ওই সব আইন ও বিধিবিধানসমূহে বাজার ব্যবস্থাপনা, মজুদদারি রোধ কিংবা তদারকির ক্ষেত্রে যথাযথ আইনগত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দেয়া নেই। যার কারণে আইনগত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়ে কৃষি বিপণন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, পেঁয়াজ ও চালের মূল্য অস¦াভাবিক পর্যায়ে থাকার মূল কারণ কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি। এর সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট জড়িত। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কয়েক দফা চেষ্টা করেও তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি। কারণ কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, ভোক্তার জন্য সহনীয় মূল্য স্থিতিশীল রাখা, বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, খাদ্যপণ্যে ভেজাল এবং কীটনাশক ও কেমিক্যালের অবাধ ব্যবহার রোধই হচ্ছে আইনটির উদ্দেশ্য। উল্লিখিত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশে পর্যাপ্ত আইনগত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বিদ্যমান আইনসমূহে নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা করলেও আইনের ফাঁকফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। নতুন আইনের মাধ্যমে গুরুদ-ের ব্যবস্থা থাকলে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতরা নিরুৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। তাই তারা আরও কঠোর শাস্তির পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সময়ের প্রয়োজনে আইন যুগোপযোগী করা হচ্ছে। তবে অপরাধের তুলনায় শাস্তির পরিমাণ কম নির্ধারণ করা হলো কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি আইন প্রণয়নের আগে সব মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হয়। সব অংশীজনের মতামত নেয়া এবং একাধিক সেমিনার করা হয়। সকলের সুপারিশ সমন্বিত করেই আমরা আইনটি প্রস্তুত করেছি। তাছাড়া সচিব কমিটিও তা অনুমোদন করেছে। মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন হচ্ছে এবং মন্ত্রিসভার ক্ষমতা আছে আইনের আওতায় অপরাধের শাস্তি বাড়াতে কমাতে পারবে। এটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের একক কোন কাজ নয়। খসড়া আইনে কৃষি উপকরণ ও কৃষিপণ্য ক্রয় বা বিক্রির সময় সব পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা পণ্য কেনার মূল রসিদ সংরক্ষণ করবেন এবং আদর্শ বাটখারা ব্যবহার করবেন। কৃষি বিপণন অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তা নিয়মিত পরীক্ষা করবেন। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা কৃষিপণ্য বা প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য বিক্রির সময় মোড়ক বা প্যাকেট ছাড়া পণ্যের সঠিক ওজন করবে। পণ্যের ওজনের সঙ্গে মোড়ক বা প্যাকেটজাত ছাড়া পণ্যের ওজন সমন¦য় করলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- বা অনূর্ধ ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। নতুন আইনে কর্পোরেট কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত নরম অবস্থা নেয়া হয়েছে। কৃষিপণ্য বা প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের গুণাগুণ ও স¦াস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকারী কৃষিপণ্যের মোড়কে পণ্যের পুষ্টিমান ও উপাদানের শতকরা হার, উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং বিক্রয় মূল্য উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকারীদের পক্ষ থেকে এ আইন লঙ্ঘন করলে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- অথবা অনূর্ধ ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে টমেটো, অপরিপক্ব ফল পাকানো অথবা দুধ, মাছ, গোশত, ফল শাকসবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশে জনস¦াস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা বা বছরের কারাদ-ের বিধান রাখা হচ্ছে। আইনটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে চেইনশপ এবং কৃষিপণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো। সংঘটিত অপরাধের বিচারের সুবিধার্থে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং ম্যাজিস্টেট্রকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনটির ৬ ধারায় কৃষিভিত্তিক শিল্প ও ব্যবসা, কৃষিভিত্তিক দল, চুক্তিভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, মার্র্কেট চার্জ ও ভাড়া নির্ধারণ, সুপারশপ পরিদর্শন, বাজার তথ্য সংগ্রহে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অন্য কর্তৃপক্ষের সহায়তা গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া কৃষিপণ্যের ব্যবসা করা যাবে না। গুদাম, হীমঘর, সংরক্ষিত পণ্য, সরবরাহ ব্যবস্থা, মজুদকৃত পণ্যের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শন করতে পারবেন।
×