ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বত্রিশে হামলার ছক ॥ মন্ত্রী ও এমপিসহ শতাধিক হত্যার পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৯ এপ্রিল ২০১৮

বত্রিশে হামলার ছক ॥ মন্ত্রী ও এমপিসহ শতাধিক হত্যার পরিকল্পনা

শংকর কুমার দে ॥ জাতীয় শোক দিবসে গত বছর ধানম-ির ৩২ নম্বরে মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক মানুষকে হত্যার জন্য নব্য জেএমবির জঙ্গীরা যে ছক কষেছিল সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থায়নে জড়িত ছিল নারী জঙ্গী হুমায়ারা ওরফে নাবিলা। এই নারী জঙ্গী নব্য জেএমবির সিক্রেট যোগাযোগ এ্যাপসে নিজের যে আইডি খুলেছিল তার নাম ‘ব্যাট উইমেন’। দুই দিনের রিমান্ডে এনে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। রবিবার হুমায়ারাকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসির উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেছেন, হুমায়ারাকে জিজ্ঞাসাবাদে সে যেভাবে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে এবং জঙ্গী তৎপরতার সম্পর্কে অনেক নতুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। বগুড়া থেকে গ্রেফতার হওয়া হাই প্রোফাইলের জঙ্গী আকরাম হোসেন নিলয় এবং তার বোনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে হুমায়ারা। এক সময় সে নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করতে বিভিন্ন সময়ে অর্থও দিয়েছে হুমায়ারা। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর হুমায়ারা নব্য জেএমবির সিক্রেট যোগাযোগ এ্যাপসে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেখানে হুমায়ারা নিজের আইডি খুলেছিল ‘ব্যাট উইমেন’ নামে। ফলে ‘ব্যাট উইমেন’ নামেই সংগঠনের অন্য সদস্যরা চিনত হুমায়ারাকে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, হুমায়ারার বাবা বড় ব্যবসায়ী। ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হুমায়ারা ওরফে নাবিলা। ভিকরুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হয় নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তাজরীন খানম শুভর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তাজরীন খানম শুভর ভাই আকরাম হোসেন নিলয় নব্য জেএমবির হাই প্রোফাইলের একজন নেতা, যাকে সম্প্রতি বগুড়া থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসি। তাজরীন খানম শুভর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে হুমায়ারা ওরফে নাবিলাও। এরপর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ের প্রধান। নিজস্ব যোগাযোগ চ্যানেলে ব্যাট উইমেনের মাধ্যমে যোগাযোগ করত হুমায়ারা। সে মালয়েশিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ওই একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ত আকরাম হোসেন নিলয়। নিলয়ের মতো হুমায়ারার সঙ্গে হলি আর্টিজানে হামলাকারী রোহান ও নিবরাসের সঙ্গে পরিচয় ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য হুমায়ারাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য নেয়া হয়েছে। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হুমায়ারা ওরফে নাবিলার বাবা জাকির হোসেন রাজধানীর হাতিরপুলের একটি নামী-দামী প্লাজার মালিক। দুই ভাইবোনের মধ্যে হুমায়ারা ওরফে নাবিলা ছোট। স্বামী তানভির ইয়াসিম করিম গ্রেফতার হওয়ার পর গুলশানের বাসা থেকে সিদ্ধেশ্বরীতে বাবার বাসায় চলে আসেন হুমায়ারা। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকতেন তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গত বুধবার রাতে সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ধনাঢ্য পরিবারের এই মেয়ে হুমায়ারা ওরফে নাবিলাকে। জাতীয় শোক দিবসে গত বছর ধানম-ির ৩২ নম্বরে মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক মানুষকে হত্যার যে ছক কষেছিল জঙ্গীরা, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত ছিল হুমায়ারা। অবশ্য জাতীয় শোক দিবসে হামলার আগেই সিটিটিসির অভিযানে হামলার প্রস্তুতি নেয়া আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয় সেই জঙ্গী সাইফুল ইসলাম। হুমায়ারাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে দুই দিনের রিমান্ডে এনেছে বৃহস্পতিবার। দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে রবিবার। জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে হাই প্রোফাইলের জঙ্গী আকরাম হোসেন নিলয় এবং তার বোনের মাধ্যমে হুমায়ারা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে একসময় সে নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করতে বিভিন্ন সময়ে অর্থও দিয়েছে হুমায়ারা। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর হুমায়ারা নব্য জেএমবির সিক্রেট যোগাযোগ এ্যাপসে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেখানে হুমায়ারা নিজের আইডি খুলেছিল ‘ব্যাট উইমেন’ নামে। জঙ্গী সংগঠনের অন্য সদস্যরা ব্যাট উইমেন নামেই তাকে চিনত। হুমায়ারার সঙ্গে আরও অন্তত ১০-১২ নারী নব্য জেএমবির সিস্টার উইংয়ে কাজ করত বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। রিমান্ডে নিয়ে হুমায়ারাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সহযোগী নারী জঙ্গীদের নাম ঠিকানা জানতে পেরেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসির দাবি। সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, হুমায়ারা ওরফে নাবিলার স্বামী তানভীর ইয়াসিন করিমকে গ্রেফতার করা হয় গত বছরের ১৯ নবেম্বর। তানভীরও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। আগে থেকেই দু’জন পরিচিত হওয়ায় তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দু’জনই জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন একসঙ্গে। হুমায়ারার স্বামী তানভীর ইয়াসিন করিম যদিও গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের কাছে বলেছেন, স্ত্রী হুমায়ারার প্রভাবেই জঙ্গীবাদে জড়ানো ও সাংগঠনিক কাজে অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ করতেন তিনি। জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের বাইরে তিনি ইসলামি বই প্রকাশনার কাজ করতেন। তার একাধিক প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। হুমায়ারা এবং তার স্বামী দু’জনই বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে যে হামলার পরিকল্পনা করা হয় এর অর্থ যোগানেও অংশ ছিল হুমায়ারার। এমনকি হামলার পুরো বিষয়টিও তার জানা ছিল। হুমায়ারার স্বামী তানভীরকে গ্রেফতারের সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিল হুমায়ারা। এ কারণে সেসময় তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে তাকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছিল। রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও তে বিস্ফোরণের যে মামলায় হুমায়ারাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট রাজধানীর ধানম-ির ৩২ নম্বরের অদূরে শুক্রাবাদের পান্থপথে অবস্থিত হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের পুরনো ভবনে জঙ্গীরা আশ্রয় নিয়েছে এমন খবর পেয়ে অভিযান পরিচালনা করে কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট-সিটিটিসিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ অভিযানে সাইফুল নামে এক জঙ্গী আত্মঘাতী হয়। ঘটনার পর সিটিটিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, তার কাছে যে বোমা ছিল তা নিয়ে ওইদিন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল জঙ্গী সাইফুলের। ওই ঘটনার পর থেকেই এ হামলার মদদদাতাদের খুঁজছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর গত বুধবার রাতে সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ধনাঢ্য পরিবারের এই মেয়ে হুমায়ারা ওরফে নাবিলাকে। দুই দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে হুমায়ারা যেভাবে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছে এবং জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে যেভাবে জঙ্গী তৎপরতায় অর্থায়নসহ জঙ্গী হামলার ছক কষে পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত হয়েছে তার নেপথ্যে কাহিনী বের করেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসির দাবি।
×