ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই মহান নেতার নেতৃত্ব

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ৯ এপ্রিল ২০১৮

স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই মহান নেতার নেতৃত্ব

দুই নেতার একজন হলেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অপরজন ’৭১-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী এবং ওই সময়ের বাঙালীর বিপদের অকৃত্রিম বন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানী সামরিক, বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর আচরণ ও বৈষম্যের কারণে খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার জেল খেটেছেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। একবার বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হলেন খুব সম্ভবত ’৬৬-এর শেষ দিকে এবং কারাগারে কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান মণি সিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু মণি বাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে কিভাবে স্বাধীন করা যায় সেই বিষয়ে মতবিনিময় করেন। এ বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি মরহুম ফরহাদ সাহেব তার রচিত বইয়েও এই তথ্যটি উল্লেখ করেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি শুধুই একটি নিছক মামলা ছিল না। এ মামলাটি মিথ্যা হলেও শাসকগোষ্ঠীর কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ। ইতিপূর্বে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে শত্রুর দয়ায় অরক্ষিত থাকে। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর কথা সক্রিয়ভাবে ভাবতে থাকেন। তারপর ১৯৭০-এ উপকূল অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দশ লাখ মানুষের সলিল সমাধিতে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ’৭০-এ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। সামরিক জান্তা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে দেখে সেদিন থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। এবার দেখা যাক ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমি যদি তোমাদের আদেশ দিতে নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো। অর্থাৎ তিনি জানতেন শত্রু আক্রমণ করবে। সেক্ষেত্রে তিনি আটক বা নিহতও হতে পারেন। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আরও মনে করতেন বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা সামরিক জান্তা কখনও মেনে নেবে না। পশ্চিমারা মনে করত ৬ দফা দাবি মানার অর্থই হবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের নামে বিনা বাধায় পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন হবে। তার ওপর ৭ মার্চের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধুর ৪ দফা শর্ত ঘোষণা ছিল গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কাজেই বঙ্গবন্ধু প্রচ-ভাবে বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানীরা এ সকল দাবি মেনে নেবে না। বঙ্গবন্ধুর এ সকল দাবির ব্যাপারে ছিলেন অনমনীয়। কাজেই পাকিস্তানীরা যে শক্তি প্রয়োগ করবে সে ব্যাপারে তিনি আগেভাগেই সতর্ক ছিলেন। সেজন্য ৭ মার্চের আগে ও পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন হলে বিশেষ করে ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, মোহসীন হলে বাঁশের কিংবা ডামি রাইফেলের মাধ্যমে ট্রেনিং চলত। প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় মার্চ মাস এলেই টিভি চ্যানেলগুলোতে ওই সময়ের মহড়া দেখানো হয়। এজন্যই সামরিক জান্তার শ্যেনদৃষ্টি ও ক্ষোভ ছিল এ সকল হলের ওপর এবং সার্চলাইট অপারেশনে প্রথমেই এই হলগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়। জে. ইয়াহিয়া লোক দেখানো মিটিংয়ের নামে তার দলবল ও ভুট্টোকে নিয়ে ঢাকায় আসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিটিং করার জন্য এবং পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকেন। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু আলোচনার অগ্রগতি না দেখে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলেন, শত্রু শক্তি প্রয়োগ করবে নিশ্চিত। আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন অন্যান্য সহকর্মীকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। সবশেষে যখন চূড়ান্তভাবে আলোচনা ভেঙ্গে যায় এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছেন তৎক্ষণাৎ তিনি তার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে মিটিং করে তাদের নির্দেশ দেন তারা যেন নিরাপদ স্থানে চলে গিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। এ প্রসঙ্গে বিরোধী বিএনপি নেতাদের আরেকটি প্রশ্নের আলোচনা না করলে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা ও কুশলী নেতৃত্ব সম্বন্ধে ধারণা করা যাবে না। বিরোধী প্রতিপক্ষ নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, পাকবাহিনীর হামলা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু কেন জাতিকে অরক্ষিত রেখে এবং সকল নেতাদের ছেড়ে পাকবাহিনীর কাছে ধরা দেন। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র- ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার ছিল ধারাবাহিকতার ফসল’ শিরোনামে লেখা থেকে জানা যায় শাহরিয়ার কবিরের নেয়া এক সাক্ষাতকারে সংসদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতার জানিয়েছেন ১৯৬৯ সালে লন্ডনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে ১৯৬৪ সালে বিএলএফ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের অনুকাঠামো গঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতের সাহায্যের বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য যে আলোচনা করেছিলেন সেখানে বিএলএফ নেতাদের সম্ভাব্য গেরিলা প্রশিক্ষণের বিষয়টি বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি পুরো বিষয়টি তাজউদ্দীনকে জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, চিত্তরঞ্জন বাবু শাহরিয়ারকে আরও জানিয়েছিলেন ২৫ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধু তাকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন দুইটি বাড়ি ভাড়া করার জন্য, যাতে সময় এলে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ জড়ো হয়ে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। সম্প্রতি ভারতে তৎকালীন ১৯৭১ সালের বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীর আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে যেসব তথ্য বিধৃত হয়েছে তার সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সাক্ষাতকারের মিল ও ধারাবাহিকতা আছে। ২৫ মার্চের আগে ইন্দিরা গান্ধী রুস্তমজীকে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদার রুস্তমজীর নির্দেশে ২৬ মার্চের পরে তাজউদ্দীন আহমদকে খুঁজে বের করেন এবং দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। কাজেই বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা ও গেরিলা যুদ্ধের ব্যবস্থাও করে যান। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ সহকর্মীদের প্রচ- চাপের মুখেও দেশবাসীকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, আমি জাতির এই দুর্যোগময় সময়ে চলে গেলে জাতি ভুল বুঝবে এবং হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে না পেয়ে অনন্যোপায় হয়ে আরও বেশি হত্যা চালাবে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু যদি দেশের মুক্তাঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে নেতৃত্ব দিতেন তাহলে নিজ দলে যেখানে বিশ্বাসঘাতক, কনফেডারেশনের সমর্থক ও সুবিধাবাদী খন্দকার মোশতাকের মতো নেতারা রয়েছেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বা স্বাধীনতা সংগ্রাম বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। আর ভারতে আশ্রয় না নিয়ে তিনি বিচক্ষণতার কাজটিই করেছেন। প্রথম প্রথম ভারত সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্ব থাকলেও পরবর্তীতে আর সেটা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। ভারতের মাটিতে অবস্থান করে নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতাও থাকবে না। ২৫ মার্র্চ রাতে মিটিং শেষে সহকর্মীদের বিদায়ের ঘণ্টা দুয়েক পর আসেন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ ও ফজলুল হক মণি। বঙ্গবন্ধু তোফায়েলের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তাদের বলেন দেশের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য। তোফায়েল ও মণি বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করে চলে যান। পরে বঙ্গবন্ধু পিলখানার ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেন এবং সেই সঙ্গে নিজের পরিণাম জানা সত্ত্বেও নিজ বাসভবনে অবস্থান করেন। এখানেই রাজনীতির সুদক্ষ দাবা খেলোয়াড়ের মতো বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ নেতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। অপরদিকে আরেক নেতা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সঙ্গে অপর নেতা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও দুই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন থাকলেও ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশাল নেতৃত্বের কিছু খ-িত অংশ এখানে আলোচনা করা যাক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ অপর দুই বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সময়টা সম্ভবত আগস্টের মাঝামাঝি। তখন বাংলাদেশে প্রবল বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল মানেকশকে দেখেই কুশলাদি বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করেন, মুক্তিবাহিনীর খবর কি? জবাবে জে. মানেকশ জানান, মুক্তিবাহিনী কোনরকমে পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়ে টিকে আছে। আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি শুধু আপনার আদেশের জন্য। বাংলাদেশে এখন প্রবল বন্যা চলছে। পাকবাহিনীর অধিকাংশ জওয়ান সাঁতার জানে না। মুক্তিবাহিনী জনগণ পক্ষে আছে, আপনি আদেশ দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারব। ইন্দিরা গান্ধী এ কথা শুনে তীর্যকভাবে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলেন, আমরা কেন পাকিস্তান আক্রমণ করতে যাব? আক্রমণ করলে এতদিন ধরে পাকিস্তান যে ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল তা মুসলিম বিশ্ব, পশ্চিমা বিশ্ব, জাতিসংঘ তথা বিশ্ববাসীকে বোঝতে সক্ষম হবে। পাকিস্তান বলবে, এই দেখ আমরা যে এতদিন বলছি ভারত আগ্রাসী, সাম্রাজ্যবাদ এবং অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পাকিস্তানের অখ-তা নষ্ট করছে, এই আক্রমণই তার প্রমাণ। আমরা তা করব না। আপনি সামরিক নেতা, সামরিক ক্ষেত্রে আপনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ। রাজনীতির দাবা খেলা তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলা আপনারা বুঝবেন না। সময় হলে অবশ্য অবশ্যই পাকিস্তান তার স্বার্থে ভারত আক্রমণ করবে। কাজেই ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। মনে রাখুন, আমি যদি আপনাদের আদেশ দিতে নাও পারি আপনারা শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। হামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এ আমার আগাম আদেশ। তার কয়েক মাস পর অর্থাৎ অক্টোবরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণ ঘটে। দীর্ঘদিন বুর্জোয়া আমেরিকার সঙ্গে কমিউনিস্ট চীনের যে হিম শীতল সম্পর্ক ছিল পাকিস্তানের জোর দূতিয়ালির কারণে হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের মাধ্যমে তা উষ্ণ সম্পর্কে পরিণত হয়। এই ঘটনায় ইন্দিরা গান্ধী খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লে গান্ধীজীর বিচক্ষণ ও গুণধর বাঙালী রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডিপি ধরের পরামর্শে অপর সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২০ বছরের মৈত্রী চুক্তি করেন। এই চুক্তির প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল দুই দেশের যে কোন একটি দেশ তৃতীয় পক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হলে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। এই চুক্তির ফলে উপমহাদেশসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। চুক্তি হওয়ার কয়েকদিন পর পুনরায় গান্ধীজী তিন বাহিনীর প্রধানদের তার অফিসে ডেকে পাঠান। আবারও মিসেস গান্ধী জেনারেল মানেকশকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা জানতে চাইলে মানেকশ বলেন, ভাল নয়। একটি আধুনিক সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে ১৭ দিনের ট্রেনিং আর পুরাতন অস্ত্র দিয়ে কতদিন টিকে থাকা যায়। মিসেস গান্ধী নির্দেশ দিলেন এখন থেকে কালবিলম্ব না করে মুক্তিবাহিনীকে আগের চেয়ে দ্বিগুণ অত্যাধুনিক সব ধরনের অস্ত্র, রসদ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সাহায্য পাঠাবার দ্রুত ব্যবস্থা করুন। মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে নতুন উদ্যোমে পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে রণাঙ্গনের চেহারা পাল্টে যায়। নবেম্বরে রণাঙ্গনে পাকিদের বিভিন্ন চৌকিতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলার পাশাপাশি সম্মুখযুদ্ধও দেখা যায়। আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার, পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর চাপ বেড়ে যাওয়া ও তাদের হাতে ভারতীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। অবশেষে মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ৩ ডিসেম্বর ভারতের অমৃতসর, জয়পুর, জম্মু-কাশ্মীরসহ বিভিন্ন শহরে বিমান আক্রমণ করলে তৎক্ষণাৎ ভারতীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় থাকাবস্থায় আক্রমণের খবর পেয়েই তাৎক্ষণিকভাবে হেলিকপ্টারে চড়ে রাজধানীতে যাওয়ার পথেই আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দেন। পূর্ব রণাঙ্গনে ১৩ দিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে একটি নতুন স্বাধীন দেশ ও জাতির জন্ম লাভে সাহায্য করে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। উপরিল্লিখিত ঘটনার মধ্য দিয়েই দুই নেতার দুর্লভ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আলাদাভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক নিয়ে লেখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার উপরিল্লিখিত ক্ষুদ্র লেখাটির বিবরণীতে বঙ্গবন্ধুর ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্তুত করা, নেতৃত্ব ও মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ আছে। তারপরও দুই-একটা কথা না বললেই হয় না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতেই প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু আটক হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। এরপরও এ বিষয়ে বিতর্ক করা সংবিধান ও আদালত অবমাননার শামিল। যারা জেনেশুনে নিজেরা ইতিহাস বানাতে চায় বা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইতিহাসের নিজস্ব গতিধারায় একদিন এ সকল জ্ঞানপাপী শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতারা এমনভাবে ছিটকে পড়বেন যে, একদিন তাদের ছাত্র, ভক্তরা তাদের খোঁজও নেবে না। যে সকল ছাত্র/ভক্তদের মিথ্যা ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে, মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, একদিন তারাই সত্য জানার পর এ সকল শিক্ষক, রাজনীতিককে ঘৃণা করবে। বেশি দূরের ইতিহাস নয়, পলাশী যুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক রবার্ট ক্লাইভ দেশে ফিরে গেলে নবাব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে অন্ধকোপের মিথ্যা প্রচারণার কারণে দেশের মানুষ তাকে শাস্তি দেয় ও ঘৃণা করে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। আজ যারা বিশেষ মহল বা গোষ্ঠীকে খুশি বা মনোরঞ্জনের জন্য জাতির গর্বভরা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চায় ইতিহাস তাদের শাস্তি দেবে এটাই ইতিহাসের অমোঘ বিধান। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী শিক্ষাবিদ
×