ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাতার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ আমের গুটি, উঁকি দিচ্ছে রসালো লিচু

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ৯ এপ্রিল ২০১৮

পাতার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ আমের গুটি, উঁকি দিচ্ছে রসালো লিচু

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ কদিন আগের স্বর্ণালী মুকুলের আস্তরণে ছাওয়া গাছের চেহারা পাল্টে গেছে আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চলে। মুকুল ঝরে এখন পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিতে শুরু করেছে আমের সবুজ গুটি। গাছে গাছে এখন আলাদা চিত্র। মুকুলের গন্ধ শেষে আমের গুটিতে চাষীদের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করেছে। তাই গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত রাজশাহী অঞ্চলের চাষীরা। আমচাষীরা ধারণা করছেন এবার আবহাওয়া অনেকটাই অনুকূলে রয়েছে। শুধু আম নয়, রাজশাহীর গাছে গাছে উঁকি দিতে শুরু করেছে জ্যৈষ্ঠের রসালো ফল লিচুও। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার রাজশাহীতে আম ও লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে রাজশাহীতে ভাল ফলন হবে আম-লিচুর। ফল ভরা গাছের পরিচর্যায় এখন ব্যস্ত এ অঞ্চলের চাষীরা। তারা ধারণা করছেন, শেষ অবধি এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে যে পরিমাণ মুকুল ও গুটি দেখা দিয়েছে তাতে আমের বাম্পার ফলন হওয়ার আশা রয়েছে। তাই রাতদিন বাগান পরিচর্যা করে যাচ্ছেন এলাকার আম চাষী ও মালিকরা। রাজশাহীর সারি সারি আম বাগান আর সুস্বাদু ও বাহারি জাতের আমের কথা উঠলেই সবার আগে চলে আসে চারঘাট বাঘা উপজেলার নাম। এ দুই উপজেলার আমের স্বাদ সুমিষ্ট। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আগেই পর্যাপ্ত আমের মুকুল আসায় এখন পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়েছে সবুজ গুটি। আর কদিন পরেই ডালে ডালে ঝুলবে আম। রাজশাহী ফল গবেষণাগার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত বছর রাজশাহী জেলায় আমের বাগান ছিল ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে। এবার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। আমচাষীরা জানান, এবার মৌসুমে রাজশাহীতে তীব্র শীত ছিল। মাঘেও ছিল শীতের প্রকোপ। সময়ের কিছুটা পরে এসে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়। তাই মৌসুমের খানিকটা পরে এ অঞ্চলের আমগাছে মুকুলের পর এখন সবুজ গুটি দেখা দিয়েছে। জেলার বাঘা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ৮ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী তোতাপরি, বৌভুলানী, রানীপছন্দ, জামাইখুসি, গোপাললাড়ু, ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, বৃন্দাবন, লক্ষণা, বোম্বাই খিরসা, দাউদভোগ, গোপালভোগ, আ¤্রপলি, আশ্বিনা, ক্ষুদি খিরসা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগসহ প্রায় দেড়শ জাতের আম রয়েছে এ উপজেলায়। এবার প্রায় ৯০ শতাংশ গাছে গুটি এসেছে। এ উপজেলায় ৮৩ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা বেগম বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষ করলে এর উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি সঠিক সংরক্ষণ, পরিবহন, রফতানিসহ বাজারজাতকরণ করলে আয়ও বাড়বে। পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ রোধ করা গেলে আমের স্বাদ গুণগতমানও বাড়বে। তিনি আরও জানান, এ বছর ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন আম দেশের বাইরে রফতানি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে। শুধু আম নয়, বিখ্যাত রাজশাহীর লিচুও। স্বাদে এবং গন্ধে অতুলনীয়। বর্তমানে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সুমিষ্ট এ ফলটি। ইতোমধ্যে দুইবার বৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজশাহী অঞ্চলে চলতি মৌসুমে যখন লিচুর ফুল ফুটতে শুরু করে তখন আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। এ ধরনের আবহাওয়া লিচুর ভাল ফলনের জন্য উপযোগী। তাই এ বছর লিচুর বাম্পার ফলনের আশা করছেন চাষী ও কৃষি কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার লিচুর উৎপাদন হবে ভাল। তবে এ জন্য চাষীদের গাছ পরিচর্যায় আন্তরিক হতে হবে। এ কারণে চাষীরাও রয়েছেন গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে শুধু লিচু চাষ করে জেলার দুই শতাধিক চাষী স্বনির্ভর হয়েছেন। তাই লিচুচাষ বাড়ছে। চাষীদের মধ্যে এ ফলটির চাষ ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে রাজশাহীতে দেড় শতাধিক লিচু বাগান হয়েছে। বাগান ছাড়াও বসতবাড়িতে দেশী লিচুর পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল চায়না-৩ এবং বোম্বে ও মাদ্রাজি জাতের লিচু চাষ হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি এলাকার বসতবাড়িতে কয়েক বছরে লিচু গাছ লাগানোর প্রবণতা বেড়েছে। রাজশাহী নগরীর রায়পাড়া, বুলনপুর, ছোটবনগ্রাম ও কাটাখালী এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষ শুরু হয়েছে। এছাড়া জেলার বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, পবা ও গোদাগাড়ী উপজেলাতেও চাষ হচ্ছে লিচু। প্রতিটি বাগানের গাছগুলোতে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে লিচুর গুটি। চাষীরা জানিয়েছেন, গাছের গুটি এরই মধ্যে বড় হতে শুরু করেছে। তাই গুটি টিকিয়ে রাখতে তারা বিভিন্ন রাসায়নিক ওষুধ স্প্রেসহ পরিচর্যার কোন ত্রুটিই রাখছেন না। গত বছর ঝড়ে লিচু ঝরে পড়ে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তারা। এবার গাছে গাছে গুটির আধিক্য দেখে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার স্বপ্ন দেখছেন তারা। জেলার পবা উপজেলার বড়গাছি গ্রামের লিচু চাষী আবদুল কাদের বলেন, আবহাওয়া যদি শেষ পর্যন্ত ভাল থাকে তবে এবার লিছুর ফলনও ভাল হবে। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, কয়েক বছর আগেও লিচুর ‘অফ ইয়ার’ বা ‘অন ইয়ার’ ফলন হতো। এক বছর ভাল ফলন হলে পরের বছর আর হতো না। এখন আর সে রকম হয় না। পরিচর্যার কারণে এখন আর অফ বা অন ইয়ার বলে কিছু নেই। ফলে বাড়ছে ফলন। পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতিবছরই ফলন বাড়াচ্ছেন চাষীরা। এবারও ভাল ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রাজশাহীর উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালি জানান, জেলায় এখন ৪৭৬ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে লিচুর বাগান আরও বাড়বে বলবে মন্তব্য করেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
×