ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

গবাদিপশু খাতের এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৮ এপ্রিল ২০১৮

গবাদিপশু খাতের এগিয়ে চলা

দেশে গত কয়েক বছরে বেড়েছে গবাদিপশুর সংখ্যা। বাড়ছে খামারি। বাড়ছে আমিষের ঘাটতি পূরণের পরিমাণ। বেড়েছে কর্মসংস্থান ও পুঁজির বিনিয়োগ। এমনকি জিডিপিতে এ খাতের অবদানও আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে। অনেকটা নীরব-নিভৃতে এগিয়ে চললেও এখাত ক্রমে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কিন্তু এরপরেও গবাদিপশু পালনে রয়ে গেছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে দেশীয় গবাদিপশু পালনে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষের কাছে গবাদিপশু বরাবরই নির্ভরশীল প্রাণী। মাত্র কয়েক দশক আগেও দেশের জমি চাষাবাদে গবাদিপশু বিশেষ করে গরু-মহিষের বিকল্প ছিল না। মাংসের চাহিদার উল্লেখযোগ্য মেটানো হতো গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া থেকে। আর দুধের কারণে তো আমাদের অন্যতম পরিচিতি ‘দুধে-ভাতে বাঙালী’। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধিতে অকাল মৃত্যু এবং চাষাবাদে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে একটা সময়ে গবাদিপশু পালন দেশে অনেকটা অবহেলার খাতে পরিণত হয়। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে গবাদিপশুর এ খাত। ২০১৭ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে দেশে গরুর সংখ্যা বেড়েছে ৭ লাখ ৬৪ হাজার। ২০০৯-১০ এর একই অর্থবছরে দেশে মহিষের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৪৯ হাজার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৬ হাজারে। এ সময়ে দেশে মহিষের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ২৭টি। ছাগল-ভেড়াসহ গবাদিপশুর সর্বমোট সংখ্যা ৫ কোটি ৬ লাখ ৫২ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৮৭ হাজারে। অর্থাৎ গবাদিপশুর মোট সংখ্যা বেড়েছে ৪১ লাখ ৩৫ হাজার। গবাদিপশুর সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে বেড়েছে দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ। বেড়েছে খামার ও খামারির সংখ্যা। সরকারী হিসেবে-বর্তমানে দেশে দুগ্ধ খামারের সংখ্যা ১২ লাখ ১ হাজার ৪৩২টি। যা ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল মাত্র ৭৯ হাজার ৯৪২টি। এক্ষেত্রে ৭ বছরে দেশে দুগ্ধ খামারের সংখ্যা বেড়েছে ১১ লাখের ওপরে। যদিও বেসরকারী হিসেবে দুগ্ধ খামারের সংখ্যা আরও কিছুটা বেশি। একই সময়ে গরু মোটাতাজাকরণ খামারের সংখ্যা ৩৩ হাজার থেকে উন্নীত হয়েছে ১৯ লাখে। এক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি শতভাগের চেয়ে বেশি। ২০১৭ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে দুধের উৎপাদন ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টন হলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখ ৩০ হাজার টনে। অর্থাৎ ৭ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন বেড়েছে ২৮ লাখ ৬৫ হাজার টন। যদিও দেশে এখনও দুধের অপূর্ণতা রয়ে গেছে। উৎপাদিত দুধ দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুধের চাহিদা ছিল ১৫ মিলিয়ন মেট্রিকটন। এর বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৭ মিলিয়ন মেট্রিকটন। অর্থাৎ ৮ মিলিয়ন মেট্রিকটন দুধের চাহিদা রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মাস এ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে দুগ্ধ ও মাংস শিল্পের প্রসার খুব বেশিদিন আগের নয়। মাত্র দুই দশক আগে শুরু হলেও বর্তমানে জিডিপিতে পশু সম্পদের অবদান ৩ দশমিক ২১ শতাংশ। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ২১ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িত। অপ্রত্যক্ষ জড়িত রয়েছে আরও বহু মানুষ। আর আমিষের চাহিদার ৮ শতাংশই আসে মাংস ও দুধ থেকে। কোরবানির চাহিদা মেটাতেও আমাদের গবাদিপশু খাত অনেক এগিয়ে গেছে। কোরবানিতে ৬০-৬৫ লাখ গবাদিপশু জবাই হলে এর ৮০ ভাগই পূরণ হয় দেশের অভ্যন্তর থেকে। এসব পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণ মেলে দেশের গবাদিপশুর খাত নীরব-নিভৃতে অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু এরপরেও আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি দেশীয় গবাদিপশু খাত তেমন একটা এগুচ্ছে না। খামারে যে গবাদিপশু লালন-পালন করা হয় তার পুরোটাই বিদেশী এবং সংকর প্রজাতির। আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই দেশীয় গবাদিপশু পালন ক্রমে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে সমুদ্রঘেঁষা অসংখ্য চর ও দ্বীপগ্রাম। এসব অঞ্চলে দেশীয় গবাদিপশু পালন অত্যন্ত লাভজনক। বহু মানুষ দেশীয় গবাদিপশু পালন করে নিজেদের ভাগ্য পাল্টে নিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গবাদিপশু বিশেষ করে দেশীয় গরু-মহিষে বিনিয়োগ করা মূল অর্থ মাত্র তিন থেকে চার বছরে ফেরত আসে। পরবর্তী গড়ে আট থেকে দশ বছর কেবল মুনাফা আসে। কিন্তু প্রধানত চারণভূমির অভাব, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাংক ঋণে জটিলতা, পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দক্ষ জনশক্তির অভাবে খাতটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। বরং দেশীয় গবাদিপশু ক্রমে কমে যাচ্ছে।
×