ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসএমই ফাউন্ডেশন

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৮ এপ্রিল ২০১৮

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসএমই ফাউন্ডেশন

জলি রহমান শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ইউরোপীয় দেশগুলোতে যে শিল্প বিপ্লব হয়েছে, তার পেছনে মূল অবদান ক্ষুদু ও মাঝারি শিল্পের। এ শিল্পের হাত ধরে সেসব দেশে বস্ত্র খাতের সম্প্রসারণ এবং পরে বৃহৎ শিল্পের বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটেও স্বল্পপুঁজিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমই শিল্পের কোন বিকল্প নেই। সরকার দ্রুত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন নামে একটি ভিন্ন সংস্থার সৃষ্টি করেছে। শিল্পায়নে নারী এবং সব শ্রেণীর এসএমই উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ ও জাতীয়পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। তৃণমূল, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় এগিয়ে নেয়া এই ফাউন্ডেশনের অন্যতম লক্ষ্য। কার্যত বিসিকের কর্মকা- ত্বরান্বিত করার জন্য এ ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করা হয়। এসএমই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন অনুবিভাগগুলো হলো- পলিসি এ্যাডভোকেসি ও গবেষণা, ফাইন্যান্স এবং ক্রেডিট সার্ভিস, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও পরিকল্পনা, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং আইসিটি, বিজনেস সাপোর্ট সার্ভিস এবং প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা। ফাউন্ডেশনের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে সরকার তহবিল হিসেবে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে। এই টাকা এফডিআর হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রেখে তা থেকে বার্ষিক অর্জিত মুনাফা ব্যবহার করে ফাউন্ডেশন এসএমই উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম ও কর্মসূচী পরিচালনা করে থাকে। বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে প্রায় ৭০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) তৈরি করবে এসএমই ফাউন্ডেশন। দেশের প্রান্তিক ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে সারাদেশকে ১৭৭টি ক্লাস্টারে ভাগ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু করেছে। এসব ক্লাস্টারে তৈরি হবে ৬৯ হাজার ৯০২ নতুন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। এতে উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ১৯ লাখের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে সুবিধা পাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) অবদান সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হলোÑ এখানে মানুষ ধীরে ধীরে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলে, সেখানে কর্মসংস্থান হয়। আর এসব শিল্প-কারখানায় যেসব পণ্য উৎপাদন হয়, সেগুলোর বাজারে চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া এর সঙ্গে জড়িতদের বেকার থাকতে হয় না। তিনি আরও বলেছেন, আগে দেশে একটি পরিবারে একজন উপার্জন করতেন, আর পরিবারের পাঁচ-সাতজন বসে খেতেন। এখন পরিবারের প্রত্যেকেই উপার্জন করেন এবং উপার্জনের জায়গাও রয়েছে। এ কারণে বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক গতি বেড়েছে। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। এর ফলে আমেরিকার মতো দেশের অর্থনীতি বসে পড়ার উপক্রম হয়, ইউরোপের বেশ কয়েকটি বড় দেশ গরিব হয়ে যায়। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশকে মন্দায় পড়তে হয়নি। তার কারণ আমাদের দেশের ক্ষুদ্র শিল্প গতি সঞ্চার করেছিল। ৬ষ্ঠ বারের মতো এবারও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় এসএমই মেলা আয়োজন করা হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী এবারের মেলায় সারাদেশ থেকে ২৭৪টি এসএমই উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। তারা ২৭৯টি স্টলে নিজেদের পণ্য প্রদর্শন করছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ১৮৩ জন নারী ৮৫ জন পুরুষ রয়েছে। মেলায় দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য, খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, আইটি পণ্য, প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্য, হস্তশিল্প, ডিজাইন ও ফ্যাশনওয়্যারসহ অন্যান্য মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের স্বদেশি পণ্য প্রদর্শিত ও বিক্রয় হচ্ছে। এসব মেলার মাধ্যমে পণ্য যেমন পরিচিত হয়। তেমনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও তাদের স্বীকৃতি পান। দেশে বর্তমানে কুটির শিল্পসহ প্রায় ৭৫ লাখ অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা দেশের মোট অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৮ শতাংশ এবং জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত এসএমই ফাউন্ডেশন ঢাকায় ৬টি জাতীয় এসএমই পণ্যমেলা এবং ২০টি আঞ্চলিক এসএমই পণ্যমেলার আয়োজন করেছে। এসব মেলায় মোট ১ হাজার ১০৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকার সামগ্রী বিক্রয় এবং ১ হাজার ২৯৭ কোটি ১৩ লাখ টাকার বিভিন্ন পণ্যের অর্ডার পাওয়া গেছে। বিশ্ব বাজারে কুটির শিল্পের ব্র্যান্ডিং করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নকশিকাঁথা ও সিলেটের শীতলপাটি ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-তালিকায় স্থান পেয়েছে। তাই উদ্যোক্তাদের এ সকল পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় এসএমই মেলা ২০১৮-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পণ্যের বাজার অনুসন্ধান এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে হবে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পণ্যের ওপর রফতানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমাদের এখন রফতানি বহুমুখীকরণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। এসএমই ফাউন্ডেশন সরকারের একটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু তাকে কার্যকর করতে হবে এবং বাস্তবে রূপ দিতে হবে। এর জন্য প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সঠিক উদ্যোক্তাদের হাতে ফাউন্ডেশনের অর্থ যাতে পৌঁছে, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশের লাখ লাখ বেকার যুবকদের কাজে লাগানোর এটাই সহজ উপায়। অল্প পুঁজিতে বহু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ক্ষুদ্র ও মাঝারি কুটির শিল্পই করতে পারে।
×