এম শাহজাহান ॥ গাইড লাইন তৈরির আট বছরে বিশ্বের কোন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা যায়নি। এফটিএর আওতায় বহির্বিশ্বে রফতানি বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গাইড লাইনটি তৈরি করা হয়। রূপকল্প-২১ অর্থাৎ আগামী তিন বছরের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানির একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে। এছাড়া স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনেও এফটিএকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার। এফটিএ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্ভাব্যতা যাচাই সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জানা গেছে, এফটিএর ফলে দেশের অর্থনীতিতে কি ধরনের আর্থিক ঝুঁকির প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে সরকারী-বেসরকারী খাতে রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে স্থানীয় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয় কি না তা নিয়ে অনৈক্যও রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে সরকারী পর্যায়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসলেও অনেক সময় বেসরকারী খাতের আপত্তি থাকছে। উচ্চ পর্যায়ে কোন গবেষণা না থাকায় কোন দেশের সঙ্গে এফটিএ করা যাচ্ছে না। ট্যারিফ কমিশন সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। এছাড়া এফটিএ সংক্রান্ত যে কোন ইস্যুতে বাণিজ্য, অর্থ, পররাষ্ট্রসহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। ফলে দেশের ভিতরে এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। অন্যদিকে এফটিএ করতে আগ্রহী সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, কোন দেশের সঙ্গে এ পর্যন্ত এফটিএ না হলেও বেশকিছু অগ্রগতি আছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এফটিএর বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গেও দ্রুত যাতে এফটিএ করা যায় সে ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। তিনি বলেন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি একটি জটিল বিষয়। সম্ভাব্যতা যাচাই ও এ ধরনের চুক্তির ফলে অর্থনীতিতে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে ব্যাপারে একটি সঠিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। এছাড়া স্বল্পোন্নত থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠে এসেছে। এই অর্জন ধরে রাখতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি অবশ্যই বিদেশী বিনিয়োগ আনতে হবে। রফতানি বাড়াতে কিছু দেশের সঙ্গে এফটিএ করা প্রয়োজন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠ বলেন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া এবং তুরস্কের মতো রাষ্ট্রের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে এফটিএ করা প্রয়োজন। দেশের রফতানি বাণিজ্য এবং দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে তা অর্জনে অবশ্যই এফটিএ সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সরকার প্রধানের মধ্যে এফটিএ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পরও চুক্তি কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ছে। মালয়েশিয়া ও চীন দ্রুত বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ করার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহী দেখিয়েছে। ২০১৬ চীনের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশ-চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে যৌথ সম্ভাব্যতা যাচাই সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। বাংলাদেশ-তুরস্ক এফটিএ সংক্রান্ত ফাইল লাল ফিতায় বন্দী। এসব দেশের পাশাপাশি মিয়ানমার, নাইজিরিয়া, মালি, মেসিডোনিয়া, মরিশাস, জর্দানের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে সরকারী পর্যায়ে একাধিকবার বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া এ সংক্রান্ত সম্ভাব্যতা ও যাচাই করা হয়েছে। কিন্তু কোন দেশের সঙ্গে গত আট বছরে এফটিএ চুক্তি করা সম্ভব হয়নি।
যদিও এফটিএ অনুবিভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবিভাগ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাংলাদেশের অবস্থান সুদূর করার লক্ষ্যে এই অনুবিভাগ কাজ করছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য কূটনীতির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনসহ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন, শুল্ক সুবিধা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য ও সেবার জন্য আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ, অশুল্কবাধা দূরীকরণ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ট্রেড ফোরামের নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণে এফটিএ অনুবিভাগ কাজ করে থাকে। এছাড়া এই অনুবিভাগের মাধ্যমে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সংক্রান্ত কার্যাবলী দেখা হয়। কিন্তু অনুবিভাগটির এফটিএ সংক্রান্ত অর্জন তেমন একটি নেই বললেই চলে।
চীন এফটিএ করতে আগ্রহী ॥ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী চীন। মুক্তবাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হলে বাংলাদেশের লাভ কী এবং এতে কি ধরনের আর্থিক ঝুঁকিও রয়েছে সে হিসাব পর্যালোচনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। চীনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-দুই দেশ এফটিএ সই করলে তাদের অনুকূলে থাকা বৈষম্যমূলক বাণিজ্যে যৌক্তিকভাবে ভারসাম্য আনা যাবে। এফটিএ করার ব্যাপারে বর্তমান চীনা দূতাবাস থেকেও সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, চীনের দেয়া এ চুক্তি প্রস্তাবের প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বাংলাদেশ কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে চীনের পণ্য বাংলাদেশে ঢুকলেও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে এর পরিমাণ বাড়বে কি না, কী ধরনের পণ্য বাংলাদেশে আসবে এবং এর ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, চীনের সঙ্গে বড় বিরাট বাণিজ্য বৈষম্য রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্য দেশের অনুকূলে নেই। এফটিও করার ফলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে সেটা গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। ব্যবসায়ীরা এখনই চীনের সঙ্গে এফটিএ চায় না। তিনি বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীন প্লাস্টিক পণ্যের বড় বাজার হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশটির সঙ্গে এখন এফটিএ হলে বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ডলারের একটু বেশি। এ হিসাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: