ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে

চারুকলায় লোকঐতিহ্যের পসরা, জগতের আনন্দযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৮ এপ্রিল ২০১৮

চারুকলায় লোকঐতিহ্যের পসরা, জগতের আনন্দযজ্ঞ

মোরসালিন মিজান ॥ চারুকলা অনুষদের ভেতরে প্রবেশ করতেই মন কেমন যেন নেচে ওঠে। অদ্ভুত এক ধরনের পুলক অনুভূত হয়। বৈশাখের এখনও কয়েকদিন বাকি। তাতে কী? মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি মুগ্ধ করে রাখে। হ্যাঁ, এবারও এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হবে বাংলা নববর্ষকে। সে লক্ষ্যে চলছে প্রস্তুতি। চৈত্রের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল কাজ। এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। জানা যায়, এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা হচ্ছে ৮টি স্ট্রাকচারাল ফর্ম। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির পুতুলগুলোকেই বিশেষভাবে সামনে রেখেছেন আয়োজকরা। মাছ, বক, মহিষসহ বিভিন্ন প্রাণীর আদল গড়া হচ্ছে বাঁশ দিয়ে। বরাবরের মতো এগুলোই হবে শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ। শনিবার চারুকলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সবকটি কাঠামো নির্মাণের কাজ মোটামুটি শেষ হয়েছে। বাঁশের তৈরি হলেও, বিশাল আকৃতির পাখি দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না। লম্বা সুর তুলেছে হাতি। বাইসাইকেলে চড়া সেই পুতুলটি দৃশ্যমান হয়েছে। দীর্ঘদেহী টেপা পুতুলের উপরের অংশ জোড়া দেয়া হবে, চলছে সেই প্রক্রিয়া। একটি কাঠামোতে শিকারি বক। আছে মাছও। তবে প্রধান স্ট্রাকচারটি সোনার হরিণ। এই ফর্মটিই মঙ্গল শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেবে বলে জানা যায়। আয়োজক শিক্ষার্থীদের পক্ষে এমএফএ শেষ বর্ষের ছাত্র মশিউর রহমান মিশু জানান, বাঁশের স্ট্রাকচার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এসবের শরীর কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হবে। তার পর রং করার কাজ। এটি হয়ে গেলেই স্ট্রাকচারাল ফর্ম নির্মাণের সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলা যাবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের খরচ অনেক। এই খরচের টাকা সংগ্রহ করতে দিন রাত ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। সরাচিত্রের কাজ হচ্ছে। কাগজের পাখি ফুল প্যাচা ঝুলছে সুতোয়। আর মুখোশের কথা না বললেই নয়। জয়নুল গ্যালারির সামনের খোলা জায়গায় বিভিন্ন আকার ও আকৃতির মুখোশ তৈরি করা হচ্ছে। চলছে বিক্রিও। যার যেমন পছন্দ কিনে নিচ্ছেন। অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে ফান্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। জয়নুল শিশু নিকেতনে কাগজের পাখি তৈরি হচ্ছে। এখানে কাজ করছিলেন সঞ্চিতা বিশ্বাস। তিনি জানান, প্রতিদিন অসংখ্য পাখি তৈরি করা হচ্ছে। পাখির নির্দিষ্ট কোন নাম নেই। লোক মোটিফ ব্যবহার করে পাখি তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েকশ পাখি তৈরি হচ্ছে। বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। শিল্পীদের ছবি কেনা যাচ্ছে জয়নুল গ্যালারির সামনে থেকে। এখানে প্রচুর ছবি টানানো। চারুকলায় ওয়াটার কালার ছবির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। শিক্ষকদের চিত্রকর্মের দাম ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। বড় সরার দাম ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ছোট সরা ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। বাঘ ও পেঁচা ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা। পাখি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। পেপার ম্যাশ ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। হাতপাখার দাম রাখা হচ্ছে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। শিল্পকর্ম বিক্রি হচ্ছে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এদিকে ফান্ড সংগ্রহের কাজে বড় ভূমিকা রাখেন বিখ্যাত শিল্পীরা। কারণ তাঁদের আঁকা ছবি অনেক দামে বিক্রি হয়। শিল্পীরা পুরো টাকা দান করেন আয়োজকদের তহবিলে। বিখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী ছবি এঁকে সূচনা করেছিলেন প্রস্তুতি পর্বের। শনিবার পাওয়া হলো এক ঝাঁক প্রিয় শিল্পীকে। মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক্ আলভী, কেএম মহসিন, ফরিদা জামানসহ ১৬ জন সিনিয়র শিল্পী শিক্ষকদের কমনরুম সংলগ্ন খোলা ছাদে ছবি আঁকছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাদা ক্যম্পাসে রবীন্দ্রনাথকে মূর্ত করলেন মুস্তাফা মনোয়ার। সৌম্য শান্ত চেহারার রবীন্দ্রনাথের দিকে এরপর তাকিয়ে থাকতে হলো শুধু! কাজের ফাঁকেই কথা হচ্ছিল শিল্পীর সঙ্গে। বলেন, এই ছবি আঁকছি, এটাই আমার বৈশাখ। বৈশাখ যুগ যুগের বাস্তবতা। পশুরা কোন একটি স্থানে বাস করে। মানুষ বাস করে দেশের মধ্যে। মানুষ বাস করে তার সংস্কৃতির মধ্যে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে সংস্কৃতিকে তুলে ধরি। এ কারণেই ছবি আঁকতে আসা বলে জানান তিনি। শিল্পী রফিকুন নবী আয়োজনের পুরোভাগে আছেন। গর্ব করেই বললেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সঙ্গে আমি শুরু থেকেই ছিলাম। এখন তো এটি বিশাল আকার ধারণ করেছে। এখনও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আছি। একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আনন্দ পাই। মঙ্গল শোভাযাত্রা সফলভাবে আয়োজন করতে প্রচুর শ্রম ঘাম ঢালতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, বাইরের সাধারণ মানুষ তা জানে না। তবে উৎসবের সঙ্গে নানাভাবে তারা যুক্ত হন। একাত্ম হন। এর ফলেই আয়োজনটি আজ দুনিয়াব্যাপী পরিচিতি পাচ্ছে। আয়োজকদের পক্ষে চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, এবার বেশ আগে কাজ শুরু করেছিলাম আমরা। ছাত্র ছাত্রীরাই বেশি কাজ করে। আমরা শিক্ষকরা নির্দেশনা দিয়ে থাকি মাত্র। এবারের আয়োজনের থিম ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’। কোন চিন্তা থেকে এই থিম নির্বাচন করা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ তো লাগবেই। আমরা সোনার মানুষ চাই। মানবিক মানুষ চাই। এ কারণেই সোনার হরিণকে মূল প্রতীক করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আয়োজকরা জানান, পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টার পর বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। চারুকলা থেকে বের হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল চত্বর ঘুরে আবার চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে। শোভাযাত্রার উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
×